ভাবতেই অবাক লাগে, এক’শ বছর আগেও পৃথিবীর রূপ-রং-রস ষোড়শী উর্বশীর মতো এমন রহস্যাবৃত ছিল না। যার চারিধারে সাগর-সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী খাল-বিল এবং জলাশয়। কোথাও বনভূমি, কোথাও বা ধূসর মরুভূমি। জনসংখ্যাও ছিল এখনকার অর্ধ শতাংশেরও কম। যেখানে অধিকাংশ মানুষ সহজ, সরল এবং অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবনযাপন করতো। যাদের আচার-আচরণ, ভাষা-ব্যবহার, পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গী, লৌকিকতা, সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিক মূলবোধ তুলনামূলকভাবে সবই ছিল, জমিন আসমান ফারাক। বিশেষতঃ তৎকালীন সাধারণ মানুষেরা দায় বদ্ধতায় হোক কিংবা রুচীগত সৌজন্যেই হোক, প্রকৃতপক্ষে সর্বাবস্থায় ওনারা ছিলেন সংযমী। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই গুরুজনদের অনুগত এবং সংযত হয়ে চলতেন। যার ফলে তৎকালীন স্বতঃস্ফূর্ত তরুণ-তরুণীদের মনোভাব কিংবা আবেগ-ইচ্ছা-অনুভূতির অন্তর্নিহীত তাৎপর্যের বাহ্যিক প্রকাশগুলি কখনো বয়োঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গদের দৃষ্টিগোচর হতো না। এমনকী প্রণয় সংক্রান্ত ব্যাপারে কারো সাথে হৃদ্যতা গড়ে উঠলেও কাক-পক্ষীতেও কখনো টের পেতো না। শুধুমাত্র দুু’টি সবুজ ও সুকোমল হৃদয়ের প্রগাঢ় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হতো, শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রেম- ভালোবাসা। যা সামাজিক ও পারিবারিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসারে পবিত্র বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আজীবন অটুট থাকতো এবং গড়ে তুলতেন একটি সুখের রাজপ্রসাদ। কিন্তু কোনপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলে মান-মর্যাদা ও আত্মসম্মানের টানাপোড়নে অভিভাবকদের সুশীলসমাজে অবস্থান করাও ছিল অত্যন্ত কঠিন। যে কারণে তৎকালিন মেয়েদের কলেজ-ইউনির্ভাসিটিতে পড়াশোনা করা, যুবক ছেলেদের সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে মেলামেশা করা, কিংবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘু ঘু ডাকা নির্জন দূপুরে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় মর্শগুল হয়ে আড্ডা দেওয়া, এসবই ছিল নিষিদ্ধ।
এককথায় তৎকালীন মেয়েরা চারদেয়ালের ভিতরে মাতা-পিতার কঠোর শাসনের সীমাবদ্ধের আবদ্ধে থেকে বড় হোতো। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা নিজস্ব মতামত প্রকাশ করবার স্বাধীনতাটুকুও তখন ছিলনা। প্রয়োজনবোধে অপ্রাপ্ত বয়সেই মাতা-পিতা তাঁদের রূচীসম্মত সুশীল সুযোগ্য পাত্রের সাথে বিবাহ সূত্রে মেয়েদের সংসার ধর্ম পালনের গুরু দায়িত্ব সঁপে দিতেন। শুধু তাই নয়, শুভ পরিণয়ের পরও স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি হেঁটে চলে বেড়াবার রেওয়াজও তখন ছিলনা। আমার দাদু-দিদাকেই তো দেখেছি, দাদু আরাম কেদারায় শরীর বিছিয়ে দিয়ে প্রসন্ন মেজাজে হোক্কা টেনে ধূঁয়ো ছাড়তেন। আর লজ্জাবতী কনের মতো দিদা এক হাত ঘোমটা টেনে চুপটি করে বসে থাকতেন। দাদুর মুখও দর্শণ করতেন না। কথা বলতেন ঘোমটার আড়াল থেকে অত্যন্ত ক্ষীণ শব্দে। তা বলে ওনারা কি বেরসিক ছিলেন? ওনাদের সুকোমল হৃদয়ে প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি কিছুই কি ছিল না?
অবশ্যই ছিল। কিন্তু এ যুগের ভোগবিলাসী নির্লজ্জ বেহায়া ছেলে-মেয়েদের মতো পথেঘাটে আম জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নয়। তাদের তীব্র নিন্দা ও উপহাসে পবিত্র ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করে নয়। ছিল চার-দেওয়ালের বদ্ধঘরের ভিতরে, গভীর নিশীথে, একান্ত নিভৃতে নিবিড় করে, একরাশ আবেগাপ্লুত ও আনন্দঘন মুহূর্ত্য ।
আর এখন, শুধু জীবনধারাই নয়, সারা বিশ্বজুড়ে মেশিনারী টেকনোলজি, বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য থেকে শুরু করে বদলে গিয়েছে প্রতিটি মানুষ, মানুষের ব্যক্তিগত রুচী, ধ্যান-ধারণা, মনোবৃত্তি সব। এমনকী প্রেম নিবেদন ও ভালোবাসার ষ্টাইলটাও পর্যন্ত বদলে গিয়েছে। একেবারে প্রকাশ্যে, উন্মুক্ত নীলাকাশের নীচে। যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটূ। গ্রহণ যোগ্যই নয়।
কিন্তু কেন? ভালোবাসা কি এতোই মামুলি জিনিস। এর কোনো মূল্য নেই! ভালোবাসা আসেই বা কোথা থেকে। কারণ ছাড়া কিছুই তো ঘটে না সংসারে। যেমন বসন্ত না এলে বাগিচায় ফুল ফোটেনা। মনে আনন্দ-ফূর্তি না থাকলে, পলক জেগে না উঠলে ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতিও কখনো জাগ্রত হয়না। তেমনি এক অদৃশ্যময় গভীর আনন্দানুভূতি রক্তের স্রোতের মতো স ালিত হয়ে মন-প্রাণ ও সারাশরীর মধুর শিহরণে শিহরিত না হলে ভালোবাসা কখনোই জন্ম নিতে পারেনা। যা অন্ন-বস্ত্রের মতো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অতি একান্তভাবেই প্রয়োজন। যার মধুর আবেশে মনকে করে পবিত্র, প্রভাবিত। জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য্য। বয়ে আনে আনন্দ। সমৃদ্ধি হয় সুখ আর শান্তি। এ কথা কে না জানে! কিন্তু কাঙ্গালের মতো একেবারে দিনে দূপুরে, লোকালয়ে!
সেদিন ছিল রবিবার, ছুটির দিন। দাঁড়িয়ে ছিলাম, কাঁচের চারদেওয়াল ঘেরা বাসষ্টপিজের ছোট্ট শ্যাল্টারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অপরাহ্নেই ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। বাতাসের আদ্র্যতায় কাঁচের উপর ধোঁয়ার মতো একটা ধূসর আবরণ পড়ে যাওয়ায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না কিছু। একেই লং-উইকেন্ড্, বাস একটা মিস করলেই ব্যস, তীর্থের কাকের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
ইতিপূর্বে শুরু হয় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। পড়ছে অনরবত। এমন সময় প্রায় ভিজতে ভিজতে একযুগল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দ্রুত এসে দাঁড়ালেন বাসষ্টপিজের শ্যাল্টারে। হঠাৎ দৃষ্টি বিনিময় হতেই মুচকি হাসলেন দু’জনে। ভদ্রতার সৌজন্যে আমিও ফিক করে হেসে ফেললাম। তখনই পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে তাঁদের চেহারা আর বেশভূষায় তামিল বলেই মনে হচ্ছিল। ইত্যবসরে একটি শ্বেতাঙ্গ যুবতী মেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে আমাদের ঠেলে ঢুকে পড়ল বাস ষ্টপিজের ভিতরে। চঞ্চল প্রজাপতির মতো চোখদুটো ওর চড়কির মতো ঘুরছে চারদিকে। লক্ষ্য করলাম, ডাগর চোখের বিচিত্র ইশারায় কাকে যেন কি বলছে মেয়েটি। যেমন তার রহস্যাবৃত দৃষ্টিভঙ্গি, তেমনি শূন্যের মাঝে ওর হস্তাঙ্গুলির এক নিদারুণ আকর্ষণীয় নৃত্যকলা। তবে ইঙ্গিত যাই করুক, সে যে প্রেমের সংকেত প্রেরণ করছিল, তা আর বোঝার অপেক্ষা রাখেনি। কিন্তু মেয়েটির ঐ কার্যকলাপে হঠাৎ বৃদ্ধামহিলাটির ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে আমাকে ভীষণভাবে চমকৃত করল। আমি বিস্ময়ে পলকহীন নেত্রে বৃদ্ধার উদ্বেগপ্রবণ মুখের দিকে উন্মুক্ত অন্তর মেলে চেয়ে থাকি। শুনি কান পেতে। একেবারে সাদা বাংলায় ঠোঁটদুটো চিবিয়ে চিবিয়ে ঢাকাইয়া ভাষায় বৃদ্ধা বলে উঠলেন, -‘ছ্যামড়িডা বোবা নাকি! আঙ্গুল নাচাইয়া ইগুলা কয় কি? আর কইতাছেই বা কারে? আশে-পাশে কাউরেই তো দেখিনা!’
বলতে বলতে বৃদ্ধা গলা টেনে তার সন্ধানি চোখদু’টি চারিদিকে বুলোতে লাগলেন।
বৃদ্ধা বলে উঠলেন,-‘অগোর ভাষা আমরা বুঝুম না গিন্নী। হ্যাড়া হইল গিয়া এ দ্যাশের পোলাপাইন। আমাগোর মত মাইনষেরে দশবার কিনন্যা দশবার ব্যাচতে পারব, বুঝলা! চলো, চলো শীগগির চলো, বাস আইস্যা পড়ছে!’
গলা টেনে দেখলাম, বাস আসছে ঠিকই কিন্তু বাসটার হেডলাইটে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘সরি, নট ইন সার্ভিস!’
বাসটি পলকেই নাকের ডগা দিয়ে তীব্রবেগে ছুটে বেরিয়ে গেল। আর মেয়েটি তক্ষুণিই ক্যাঁঙ্গারুর মতো থপ্ থপ্ করে পা ফেলে দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে রাস্তার বিপরীত দিকের নির্জন বাসষ্টপিজের ভিতরে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার অবাধ্য চোখের দৃষ্টিটা নিক্ষেপ করে সেদিকে। চোখ পাকিয়ে দেখি, তামাটে রং-এর এক সুদর্শণ তরুণ যুবকের পেশীবহুল প্রশ্বস্ত বক্ষপৃষ্ঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে এক রোমাঞ্চকর উন্মাদনায় মেতে ওঠে মেয়েটি। চকিতে ওর দুধসাদা মসৃণ দুইবাহু বেষ্টিত করে ক্রমাণ্বয়ে ওর চঞ্চল উষ্ণ ওষ্ঠাঘাতে যুবকটিকে ব্যাকুলিত করে তোলে। কে দেখলো, কি ভাবলো, কি মন্তব্য করলো, তাতে কিছুই এসে গেল না ওদের। এসে গেল ঐ বৃদ্ধামহিলাটির। তিনি ক্রোধে, অপমানে ফুলে ওঠেন। দৃষ্টিকটূ যুগলবন্দী নবীন প্রেমিক-প্রেমিকার প্রকাশ্যে অশোভনীয় আচার-আচরণে বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন, -‘দ্যাখছ, ছ্যামড়িডা ক্যামন বেয়াদপ, বেআক্কল, নির্লজ্জ। মানুষজন দ্যাখে না। ইগুলার ঘিন্ন্যাপিত্তাও কি নাই অন্তরে! হ্যাড় বাপ-মাও ক্যামন মানুষ! যুবতী মাইয়া একখান ছাইড়া দিছে রাস্তায়! হ্যাগোর খুঁজখবর রাখে কিছু! পোলাপাইন আমাগো আছিল না! আমরা মানুষ করছি না! এককালে আমরাউ তো আছিলাম পোলাপাইন! মা গো মা, চিন্তাই কড়ন যায়না!’
খানিকটা বিব্রোত হয়ে ধমক দিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। -‘আঃ হাঃ, তুমি হেই দিকে দ্যাখ ক্যান? তোমারে কইছি না, হ্যাড়া হইল গিয়া এই দ্যাশের পোলাপাইন। সাদা চামড়ার মানুষ। হ্যাগোর লজ্জা শরমের বালাই নাই। কুনো কালে আছিলও না। হ্যাগোর ঘর বাইর দুই সমান। হ্যাড়া বিয়া সাধির ধার ধারে না! কাউরে ডরায়ও না। হ্যাগোর মহব্বত মানেই দ্যাহের ক্ষুধায় কামনার আগুনে ডুইব্যা মরা। বাহির হইব দুই ঠ্যাঁং লইয়া, ফিরব চাইর ঠ্যাঁং লইয়া। বুঝলা না?’
বৃদ্ধা আঁতকে উঠলেন শুনে। বড় বড় চোখ মেলে হাঁ করে থাকেন বিস্ময়ে। একটা শব্দও উচ্চারিত হয় না। কিছুক্ষণ থেমে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,‘-খাইছে, কও কি গো. সব্বণাশ! আমরা এ কুন জগতে আইস্যা পড়ছি লো!’
যুথিকা বড়ুয়া : কানাডা প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।
দিদি ,অনেকদিন পর আপনার একটা সুন্দর লেখা পেলাম।
আপনার লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার সুন্দর মন্ত্যবের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যাযাবর ভাই ।