“সংকটকালীন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য”
সারা দুনিয়াতে সব মানুষই এখন কঠিন এক সময় পার করছেন। শুধুমাত্র ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায় এমন এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা পৃথিবী। প্রভাবিত করছে মানুষের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক জীবনকে। ফলে অনেকটা বন্দি জীবন যাপন করছেন অধিকাংশ মানুষ। এরকম একটি জটিল সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমুন্নত রাখা বা তার পরিচর্যার বিষয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও মনস্তত্ববিদের পরামর্শ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। আজকের লেখা এই বিষয়ে কিছু সাধারণ চিন্তা, অভিমতের প্রতিফলন। হয়তোবা কারো না কারো কিছুটা হলেও কাজে লাগতে পারে।
বর্তমানের প্রতি নজর দেয়া : টরোন্টোর নর্থ ইয়র্ক হসপিটালের মনস্তত্ত্ববিদ এবং ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোর Department of Psychiatry এর লেকচারার Jerome Perera বলেন, “Focus on today’s challenges. As difficult as it might be, it’s important to try to let go of yesterday’s regret and tomorrow’s uncertainty. Wh”at we do have is this moment. What we can control includes acknowledging feelings, shifting focus of thinking, and modifying behaviours.”। তার উদ্ধৃত বক্তব্যের শেষ লাইনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সংকটময় পরিস্থিতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়তো এখনই সম্ভব নয়, কিন্তু যা সম্ভব তা হচ্ছে মনের ভেতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা মেনে নেয়া, চিন্তা ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুকে স্থানান্তর এবং নিজের আচরণগত কিছু পরিমার্জন। এবিষয়ে মনোবিজ্ঞানী এবং মনস্তত্ববিদের কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ হচ্ছে;
– অনেকদিন ধরে ফেলে রেখেছেন এমন কিছু কাজ এখন শেষ করার চেষ্টা করুন। শরীর বা মনের পরিচর্যা হয় এমন কাজে বেশি মনোনিবেশ করুন। মস্তিস্ককে সক্রিয় রাখার জন্য মনোস্তত্ববিদরা Elevate, Limosity, Peak বা Neoronation এর মতো ফ্রি Aps গুলো ব্যবহারের উপর জোর দিচ্ছেন।
– Unplugging TV News – সারাক্ষন distressing সংবাদ আপনার আশার বাতিকে নিভিয়ে দিয়ে মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলতে পারে। সেজন্য দিনের নিদৃষ্ট কিছু সময়ে News Update দেখুন। যারা Panic Button নিয়ে সারাক্ষন সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন, তাদের থেকে দূরে থাকুন। শুধুমাত্র বিশ্বস্ত সূত্র ছাড়া কোনো সংবাদ আমলে নেবেন না, কারণ এই ভাইরাসের বিষয়ে সবাই এখন বিশেষজ্ঞ। ফেইসবুক, হোয়াটস্যাপ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করুন, সংবাদের সূত্র হিসেবে নয়।
– মাঝে মাঝে বন্ধু বান্দব, সহকর্মী, আত্মীয় স্বজনদের সাথে ফোন, ভিডিও চ্যাট করুন যাতে একাকিত্ব আপনার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে না পারে। আগ্রহ থাকলে Journal লেখা শুরু করতে পারেন। নিজের মনের অনুভূতিকে তুলে ধরতে পারেন পরবাসী ব্লগের মতো অনলাইন ফোরামে। লিখতে যেয়ে সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হবে একজায়গায়, দুশ্চিন্তা বা বিষন্নতা তখন পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে ।
– Deep Breathing Exercise করুন। মনের অস্থিরতা, উক্তেজনা কমানো ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে Breathing এক্সারসাইজ এর তুলনা নেই। এর সাথে যোগ করতে পারেন mindfulness meditation এর বিভিন্ন প্রক্রিয়া। মনোরোগ বিশারদরা বলেন এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, “to bring the focus back to breathing every time your thoughts drift away” ।
জীবনযাত্রা: খুব স্বাভাবিক কারণেই এই সময়ে মানুষের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, বিশেষ করে ভাইরাসে সংক্রমিত হবার আশংখা। মনে রাখা দরকার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আশংখার চাইতেও আরও অনেক কারণেই আমরা যেকোনো সময় মারা যেতে পারি। ডাক আসলে আমাদেরকে যেতেই হবে। সেজন্য প্রতি মুহূর্তে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। অগাধ বিশ্বাস রাখুন আপনার স্রষ্টায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিন। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অনুশীলন চালিয়ে যান। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ মেনে চলুন, প্রচুর পানি পান করুন, শরীরের আদ্রতা বজায় রাখুন। খাবারের পুষ্টিগত মান বজায় রাখার বিষয়ে মনোযোগী হন। নিজেকে আশ্বস্ত করুন এই ভেবে যে প্রয়োজনীয় সুরক্ষার কাজগুলো আপনি নিয়মিত ভাবেই করছেন।
সুচিন্তিত রুটিন: প্রতিদিনের জন্য একটি নিদৃষ্ট রুটিন তৈরী করুন। ঘুম থেকে উঠা, গোসল করা, খাওয়ার জন্য যাতে নির্ধারিত সময় থাকে এবং সেটা মেনে চলা হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। ঘর পরিষ্কার, বই পড়া, শরীর চর্চা, মেডিটেশন ইত্যাদি কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করা জরুরি। সবচেয়ে বেশি উপকারী হচ্ছে প্রতিদিনের জন্য একটি Goal Setting বা লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তার অগ্রগতি বা অর্জনকে খেয়াল করা ।
বই পড়া: বেছে বেছে ভালো কিছু বই পড়াও এই সময়ে মনকে শান্ত, সমাহিত রাখতে পারে। আমি নিজে এখন পড়ছি পবিত্র কোরআনের অসাধারণ একটি ইংরেজী অনুবাদ। নাম The Clear Quran। অনুবাদ করেছেন Dr Mustafa Khattab। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে এই অনুবাদটি পবিত্র কোরানের অন্যতম সেরা ইংরেজি অনুবাদ। প্রবাসে বেড়ে উঠা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য এটি একটি সেরা উপহার হতে পারে। অসাধারণ আরো একটি বই এখন পড়ে শেষ করার চেষ্টা করছি। বইটির মূল আরবি নাম হচ্ছে “লা তাহজান” বা “হতাশ হবেন না” । লেখক হচ্ছেন ড. আয়েজ আল কারণী। এই বই পড়ে কারো মনে হতে পারে যে উনি আরেক মুসলিম ডেল কার্নেগি। এই বইয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে এতে হতাশা, বিষন্নতা, দুঃখবোধ, আশা, চেষ্টা, উদ্দ্যোগ এরকম তিনশত আটচল্লিশটি বিষয়ে কোরআনের আয়াত, হাদিস খুঁজে বের করে তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরকম আরো অনেক বই আছে যা পড়লে হয়তো মনোবল বৃদ্ধি পাবে, কমবে মানসিক চাপ । ফলে যেকোনো পরিস্তিতি সহজ, স্বাভাবিক ভাবে মোকাবেলা করা সহজ হবে ।
প্রার্থনা: Prayer বা প্রার্থনার Healing Power নিয়ে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে সারা দুনিয়ায়। আপনি যে ধর্মেরই অনুসারীই হননা কেন, এই কঠিন সময়ে আপনার স্রষ্টার সাহায্য প্রার্থনা করুন। জগতের সব সীমাবদ্দতা নিয়ে তার কাছে হাত তুলুন। সাড়া মিলবেই। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় ( আয়াত ১৮৬) ঘোষণা করা হয়েছে, “ আমি তো তাদের খুব কাছেই আছি। প্রার্থনায় যে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাক শুনি, তার ডাকে সাড়া দেই”। আমি নিশ্চিত সব ধর্মেই বিপদে স্রষ্টার করুণা লাভের চেষ্টার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। সুযোগ পেলে Prayer নিয়ে ফ্রান্সের সার্জন Dr Alexis Carrel এর “Prayer” বইটি পড়ে দেখতে পারেন। এই বইয়ের সন্ধান জেনেছি প্রিয় লেখক সালাহউদ্দিন সৈবাল ভাইয়ের সৌজন্যে। Dr Alexis বলেন, “Prayer is the force as real as terrestrial gravity. As a physician, I have seen men, after all other therapy had failed, lifted out of disease and melancholy by the serene effort of prayer. Only in prayer do we achieve that complete and harmonious assembly of body, mind and spirit which gives the frail human reed its unshakable strength”।
জগত সংসারের অনেক কিছুই আমরা পরিবর্তন করতে পারবো না। অনেক কিছুরই নিয়ন্ত্রণ ও আমাদের হাতে নেই। ‘Panicked’ হয়ে বা ‘Panic’ সৃষ্টি করে কোনো কিছুই অর্জিত হবে না। যা অর্জন বা পরিবর্তন করতে পারবো তার জন্য দরকার শান্ত মস্তিস্ক, মনোবল ও সাহস রাখা। সেজন্য হতাশ না হয়ে, ত্রস্তব্যস্ত না হয়ে, হয়তো আমাদের মনে রাখা উচিত নিম্নের ‘Serenity Prayer’;
“God grant me the serenity
to accept the things I cannot change;
courage to change the things I can;
and wisdom to know the difference.”
আল্লাহপাক তার অপার করুনায় আমাদের সবাইকে সুস্থ রাখুন, নিরাপদে রাখুন।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে