গত ২৭এ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, অন্টারিও প্রদেশ,কানাডা নির্বাচন হয়ে গেলো। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ এবং রাত ১১টার মধ্যেই ফলাফল জানা গেলো প্রিমিয়ার: ডাগ ফোর্ড (Doug Ford ) এবং তাঁর রক্ষণশীল দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে পুনরায় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে । এ নিয়ে তিনবার ডাগ ফোর্ড প্রাদেশিক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করলেন । ইতিপূর্বে পার্টির যোগ্যতা নিয়ে প্রার্থী প্রধানদের মধ্যে টেলিভিশিনে তর্কযুদ্ধ (Debate ) প্রচার ও দেখলাম । এবারের নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের এক বৎসর পূর্বেই হলো । আমাদের বাংলাদেশী একমাত্র মিসেস: ডলি বেগম এবার নিয়ে তিনবার প্রাদেশিক সংসদ সদস্য হলেন। তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
প্রতি চার বৎসর পর পর এই নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলে ও এবার তার ব্যতিক্রম হয়েছে । এ নিয়ে অন্টারিও প্রদেশের প্রিমিয়ার মিস্টার ডাগ ফোর্ড ( Doug Ford ) এর বিরুদ্ধে অনেকে এমন কি বিভিন্ন দল প্রধান থেকে ও সমালোচনা শুনা গেছে । এ দেশে প্রায়ই সরকারের কাজের জন সমর্থন বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মাঝে মধ্যে যাচাই করা হয়,যেহেতু বর্তমানে জন সমর্থন তাঁর পক্ষে, কাজের সমর্থন ভালো, তাই সুযোগ বুঝে নির্বাচন দিয়েছে এবং সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ করেছে; আগামী চার বৎসরের জন্য চাকুরী নিশ্চিত হলো। নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের পোস্টার দেখা যাচ্ছিলো, কোনো প্রার্থীর চেহেরা দেখি নি। টেলিভিশনে সামনা সামনি যে প্রার্থী প্রধানদের তর্কযুদ্ধ (Debate ) হয়ে গেলো,কোনো প্রার্থী প্রধানকেই উত্তেজিত হয়ে আক্রমণ বা পাল্টা আক্রমণ করতে ও দেখা যায় নি -এটাই এ দেশের রাজনীতি(গণতন্ত্রের) বৈশিষ্ট। এ দেশের রাজনীতিবিদ ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির মোকাবেলা করে, জনগণ ঝগড়া বা কাদা ছোড়াছুড়ি পছন্দ করে না, যুক্তিতর্ক দেখিয়ে কাজের মূল্যায়ন বা সমালোচনা করে এবং জনগণ এ থেকে দল বা প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই করে নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকে।
অনেক সময় আমি এখানে -সেখানে এ দেশি পরিচিতকে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করি – ক) ভোট দিতে যাবে কি ?উত্তরে বলে :ক ) আমি এ সবে বিশ্বাস করি না। অথবা খ ) সরকার তাদের কাজ করবে আমি ভোট দিলেই বা কি আর না দিলেই বা কি ? অথবা গ) চুপটি মেরে যাবে,কিছুই বলবে না- আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেবে না -যেন এটা তার নিজের ব্যাপার , আমি অনাধিকার চর্চা করছি। এ দেশের নিয়ম সরকার ভালো কাজ করলে জন সমর্থন পাবে; কোনো রকম হৈচৈ বা কারো মাথা পাটাবে না। বিশেষ করে বাজার দ্রব্যমূল্য,হাউসিং(বাড়ির মূল্য ও বাড়ি ভাড়া ), চিকিৎসা সেবা সুবিধার সঙ্গে মিলিয়ে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা যাচাই করে নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকে।
২ ) এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক – গত ৫ই অগাস্ট ২০২৪ আমাদের তরুণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়ে গেলো, যার ফলে ১৬ বৎসরের আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা দেশ থেকে ফলিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে । বাংলাদেশের জন্য নতুন হলে ও -এ জাতীয় অভ্যুত্থান নতুন কিছু নয় -পৃথিবীর অনেক দেশেই হতে দেখেছি ।
ক) ১৯৭৯ সনে আমি তখন বাংলাদেশে,ইরানের শিয়া মুসলিম নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর মাধ্যমে ওই দেশে গণ অভ্যুত্থান ঘটে, যার ফলে ইরানের,রাজকীয় পরিবার সহ রেজা মোহাম্মদ শাহ ফাহলভী দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল এবং আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ধমকে আমেরিকা সরকার রেজা শাহ ফাহলভী ও তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারে নি,শেষে মিশরে আশ্রয় নেয় এবং ওখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। খ) ১৯৮৬ সনে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট লৌহ মানব ফার্ডিনান্ড মার্কোস দেশের বিপ্লবী জনগণের তোফের মুখে তাঁর স্ত্রী এমালদা মার্কোসকে নিয়ে আমেরিকার হাওয়াইয়ান আইল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই মৃত্যু হয়। গ ) সিরিয়ার আসাদ পরিবার গত ৩০ বৎসর দাপটের সঙ্গে দেশ শাসন ও শোষণ করেছে ,দীর্ঘদিনের বিপ্লবী যুদ্ধের ফলে, প্রেসিডেন্ট বাসার আসাদ এইতো ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪ মস্কো, রাশিয়া আশ্রয় নিয়েছেন । ঘ) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর আলী মির্জাকে ১৯৫৮ ,তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আয়ুব খান লন্ডন, যুক্তরাজ্যে নির্বাসন দেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান দেশের মাটিতে সমাধির অনুমতি না দেয়ায় ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ ফাহলভী তেহরানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করেন, এ ভাবেই স্বৈরশাসকদের পতন ঘটে। চ) লিবিয়ার লৌহমানব মোয়ামার গাদ্দাফি আর এক শক্তিশালী নেতা যিনি দেশের জন্য অনেক কিছু করে ও শেষ রক্ষা পান নি। ২০১১ সনে দেশের বিপ্লবী জনগণের অভ্যুথানে যে ভাবে মৃত্যু এবং সাহারা মরুভূমিতে অজ্ঞাতস্থানে সমাধিস্থ হয়েছে -তা চিন্তা ও করা যায় না।
৩ ) ১৯৫৪, আমি বয়সে ছোট , পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচনে এক ভোট কেন্দ্রে আমার পিতা আমাকে নির্বাচন কিভাবে হয় দেখানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন ,সে বৎসর আমাদের এলাকা,কচুয়া থানা থেকেই দুইজন প্রার্থী ক) আয়াত আলী ভূয়াঁ -মুসলিম লীগ এবং খ) মুজিবুল হক -যুক্ত ফ্রন্ট থেকে প্রতিযোগিতা করেছিলেন । সে বারে যুক্ত ফ্রন্ট থেকে মুজিবুল হক পাশ করেছিল এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সংখ্যাগরিষ্ট যুক্তফ্রন্ট থেকে পূর্ব বাংলার মুখ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন । সেই ক্যাবিনেটে মোহাম্মদ শাহেদ আলী পাটোয়ারী, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ডেপুটি স্পিকার, সংসদে সে দিন স্পিকার হিসাবে ছিলেন। প্রাদেশিক সংসদের সন্মানীয় সদস্যরা সংসদে মারামারি করার ফলে শাহেদ আলী পাটোয়ারী গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে নিলে দুইদিন পর মারা যায়। এ করুন কাহিনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে ; কে বা কাহারা আঘাত করে শাহেদ আলী পাটোয়ারীকে গুরুতর জখম করেছিল যার ফলে তিনি মারা যান,সে নাম জনগণ আজ ও জানেনা, আমরা সেই জাতি যাদের মধ্যে ধর্য্য নেই এবং সংসদের মতো একটা পবিত্রস্থানে ও মারামারি করি ।
৪ ) ১৯৬০র দিকে তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদগণ সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য নিয়ে মাঠ কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিতেন। যারা ইতিহাস জানেন , হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন ,ব্রিটিশ আমলে ভারতের ওই অঞ্চলগুলি যথা দিল্লী,পাঞ্জাব,উত্তর প্রদেশ(UP ) পশ্চিম বাংলা শিক্ষা,শিল্পে এবং যোগাযোগ উন্নত উন্নত ছিল। আমাদের পূর্ব বাংলা নিম্নভূমি- কৃষির উপর নির্ভর ছিল। আমি ১৯৭০ এর দিকে পাকিস্তানে চাকুরী করেছি; আমার দৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে যে বক্তব্য,ওটা অতিরঞ্জিত ছিল।১৯৪৭ সনে দেশ বিভক্ত হওয়ার কালে অনেক জ্ঞানী রাজনীতিবিদ পশ্চিম বাংলা বা বঙ্গকে বাদ দিয়ে পূর্ব বাংলাকে heartless বা হৃদয়হীন অঞ্চল বলতেন । সরওয়ার্দী সাহেবের মতো অনেকেই এই বন্টন নিয়ে বিরুধিতা করেছিলেন।এই অঞ্চলে বর্ষা হলে সব কিছু পানির নিচে চলে যেত ; এমন কি মুঘল আমলে ঢাক থেকে রাজধানী সরিয়ে মুর্শিদাবাদে নেয়া হয়েছিল।পূর্ব পাকিস্তানের পাটের গৌরব ও আজ আর নেই; আজকাল বাংলাদেশে পাট বলতে কোনো বস্তু আছে বলে ও বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানে না, এ হলো সময়ের পরিবর্তন। বিশ্ববাজারে আজকাল পাটের চাহিদা নেই এবং বাংলাদেশে তার চাষ বন্ধ বা হয়না বললেই চলে।
৫ ) সে যুগে বা আজ ও আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দলই হুট্ করে কোনো সভা ডাকে না -এক বা দুই মাস মাইকে ঘোষণা না দিয়ে। তার জন্য আগে থেকেই লোক ঠিক করে মাইকে প্রচার চালিয়ে লোক জড়ো করার ব্যবস্থা করে – শ্রমিক,মজদুর বা বস্তির লোকদের হাতে দলীয় ব্যানার দিয়ে দলে দলে মাঠে নিয়ে যাওয়া – খবরের কাগজে ফলাও করে প্রচার করা হয় । শ্রমিক, মজদুর বা বস্তির লোকেরা পার্টি পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল দিতে দিতে মাঠ গরম করতো ,হাজার হাজার লোক উপস্থিত না হলে ওটাকে জনসভা বলা হতো না । স্বনামধন্য নেতাগণ এবং ওদের পেছনে ছাত্র এবং দল সমর্থক জনতা স্লোগান দিতে দিতে মঞ্চে এসে জড়ো হতো । আর একটা জিনিস লক্ষণীয় ছিল- নেতাগণ উত্তেজিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যে যত বেশি বলতে পারবে,সে ততো বড় নেতা- যা দেখার জন্য হাজার হাজার জনতা মাঠে জড়ো হয় । আজকাল ও তাই হয় -আমাদের নেতাগণ অতীতের কথা বলতে এবং লোক ক্ষেপানো বক্ত্রিতা দিতে ভালো বাসে , নিজেরা ক্ষমতায় গেলে কি করবে- এ জাতীয় কোনো কন্সট্রাক্টিভ বা গঠনমূলক পলিসি নিয়ে তেমন কিছু বলে না বা জিজ্ঞেস করলে ও জবাব দিতে পারবে না ।
৬ ) ১৯৭১ র পর থেকেই দেশের শাসন ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে দুর্নীতি ঢুকে পড়ে ; দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো রিসার্ভ ছিল না, সে সময় রিজার্ভ ব্যতীত কাগজের টাকা চাপিয়ে দেশ চালানো হতো। বিদেশ থেকে রিলিফ বা ত্রাণসামগ্রী আসলেও তার প্রকৃত বন্টন হতো না। ১৯৭৪ সনের দুর্বিক্ষে দেশে প্রায় দেড় মিলিয়ন লোক মারা যায়। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ;দেশে ভুখা মিছিল এবং একটা রুটির জন্য ও মানুষ লাইনে কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো।
আমি তখন মতিঝিল,ঢাকা ইস্পাত প্রকৌশলী সংস্থায় কাজ করি, বঙ্গবন্ধু কারখানা শ্রমিকের জন্য লাভের ২.৫% দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সৌভাগ্যক্রমে আমি সে সময় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার একটা প্রজেক্টের ২.৫% লভ্যাংশের অর্থ শ্রমিকদের মধ্যে বন্টনের দায়িত্বে ছিলাম । দেশে উৎপাদন নেই, সব মিল, কারখানা লোকসানে চলছে, এ দিকে শ্রমিক লভ্যাংশের পয়সার জন্য ধর্মঘট করছে,সে অনেক কথা।
৭ ) আমি ২০২৩ বাংলাদেশে ছুটিতে , একজন মন্ত্রী যাঁর সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই অনেক স্মৃতি জড়িত ,একটু দেখা ও আলাপের জন্য গিয়েছিলাম। মনে হয় ১০০ বা তার ও অধিক লোক মন্ত্রীর সঙ্গে তদবির বা দেখা করার জন্য এসেছে, প্রচন্ড ভিড় ঠেলে সেক্যুরিটিকে বলে ভিতরে ঢুকলাম। এটা বাংলাদেশের সচরাচর দৃশ্য, আগেও বহুবার দেখেছি।একজন মন্ত্রীর বাড়ি লোকের ভিড় থাকে, বাংলাদেশের মানুষ অসহায়, পড়াশনা করলেও কাজ পাওয়া যায় না,পরিবারে এক জন কাজ করে, বাকি লোক বেকার, একমাত্র জমির উপর নির্ভর, একটু তদবিরের জন্য মন্ত্রীর বাড়ি যায়। কিন্তু মন্ত্রী সাহেব কোত্থেকে এত এত লোককে কাজ দেবে,তাই দেখা করলে হয়তো বলে, আচ্ছা দেখবো ।
৮ ) ২০০৫র দিকে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পল মার্টিন একবার আমাদের নর্থ ইয়র্ক,টরন্টো একটা স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে সভা ডাকলেন ,সেদিন আমি ওখানে ছিলাম, পুলিশ,সিকিউরিটি সব মিলে ৫০-৬০ জন লোক উপস্থিত ছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে সেখানে কয়েক লক্ষ লোক জড়ো হতো,ফুলের মালা দিয়ে মন্ত্রীকে বরণ করা হতো এবং ফলাও করে খবরে আসতো। এত কম সংখ্যক ৫০-৬০ জন লোকের উপস্থিতি,তাহলে তো অনেকের চাকুরিই চলে যেত । এ দেশে মানুষ কাজ করে, মন্ত্রীর পেছনে দৌড়ায় না।
সমাপ্ত