-আমিনুল ইসলাম মিলন
“আদমেরে কইয়া দিছো গন্ধম তুমি খাইও না, গন্ধমেরে কইয়া দিছো আদমেরে ছুঁইয়ো না”-বহুল জনপ্রিয় একটি গানের কলি। আদমকে সৃষ্টির সাথে সাথে মহান সৃষ্টিকর্তা ভাবলেন তাঁর একজন সঙ্গী দরকার। তাই সৃষ্টি করলেন বিবি হাওয়াকে। যাকে দিলেন একজন নারীর রূপ। দু’জনের দৈহিক–মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্য আলাদা। সৃষ্টির পরে তাদেরকে বেহেস্তে থাকতে দিলেন। মহান প্রভূ শুধু একটি সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন-‘গন্ধমবৃক্ষের কাছে যাবে না’। কিন্তু আদম–হাওয়াকে তো আদতে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই প্রভূ–আজ্ঞা অমান্য করে তারা গন্ধমবৃক্ষের কাছে গেলেন। নির্দেশ অমান্যের শাস্তি হিসেবে বিতাড়িত হলেন স্বর্গ হতে। পরিণতিতে মানব সম্প্রদায় আজ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে–আছে বাংলাদেশে এবং এই ঢাকা শহরে–বনানীতে।
শুধু আদম হাওয়া দু’জনকে দিয়ে তো আর বিশ্বজগৎ ভরানো যাবে না! তাই সৃষ্টিকর্তা তাঁদের দু’জনের মাঝে এমন একটি শারিরীক ক্রিয়া–বিক্রিয়ার সৃষ্টি করলেন, যার ফলে নারী–পুরুষের যৌথ প্রয়াসে জন্ম নিতে থাকে আরো একজন মানব–শিশু–নারী অথবা পুরুষ। আদিমকালে এই যৌথ বিনিয়োগের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম ছিলো না। এমন কী আদমপুত্র কাবিল কর্তৃক স্বীয় জ্যৈষ্ঠভ্রাতা হাবিলকে হত্যা করা হয় শুধু সঙ্গী নির্বাচনে নিজের চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য। এ চাহিদা নারী–পুরুষ উভয়ের শরীরে একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমার পরে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নারী–পুরুষ জৈবিক চাহিদা পূরণে একে অপরকে কাছে পেতে চায়। এ জন্য কোন শিক্ষা–পরামর্শ–অনুশীলন প্রয়োজন হয় না। এ রকম একটি গল্প শুনেছিলাম–একটি নির্জন দ্বীপে ১দিন বয়সী একটি ছেলে শিশু এবং ১দিন বয়সী একটি মেয়ে শিশুকে রেখে আসা হয়। কৃত্রিম উপায়ে তাদের অন্ন–বস্ত্রের যোগান দেয়া হয়। ১৩ বছরের মাথায় গিয়ে উক্ত দ্বীপে ৩জন আদম সন্তানের দেখা পাওয়া যায়। এটিই সত্য, এটিই বাস্তব। এটিই মানুষের যৌন চাহিদা–জৈবিক চাহিদা। স্থান, কাল–পাত্র ভেদে এটি তীব্র হয়। কোন নিয়ম কানুন–বিধি–বিধান লাজ–লজ্জার বালাই থাকে না। জাতি–ধর্ম–বর্ণ–গোত্র–ছোট–বড় ধনী–দরিদ্র কোন কিছুর ধার ধারে না। এভাবেই মানব–সভ্যতা বিকশিত হতে থাকে। সঙ্গতকারণেই প্রাথমিক পর্যায়ে ভাই–বোনে বিয়ে, আন্তঃবিয়ে প্রভৃতি প্রচলিত ছিলো। কালক্রমে মানুষের সংখ্যা বাড়ে, আদিমযুগ–গুহাযুগ পেরিয়ে এগিয়ে চলে মানুষ। সৃষ্টি হয় সমাজ–সংসার–ধর্ম প্রভৃতি বিধি–বিধান। এর আলোকে নির্ধারিত হয় নারী–পুরুষের সম্পর্ক। উদ্ভব ঘটে বিবাহ বা বিয়ে নামক এমন একটি প্রথা যার প্রধান শর্তই হচ্ছে দু’পক্ষের স্বেচ্ছা–সম্মতি। বিয়ে প্রথাই নারী–পুরুষের সম্পর্ককে সর্বপ্রথম বৈধতা দেয়। বিয়ে কি ধর্মীয় না সামাজিক প্রথা–এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আজ থেকে ৮০ বছর আগে নোয়াখালীর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম আবদুল জলিল হেডমাস্টার সাহেব বিবাহের দর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন–
On the occasion of the happy Wedlock of my nephew
Mvi. Md. Aminullah with Mossammat Afia Khatun
Philosophy of Marriage
Marriage is not a conventional convenience of society, but it is a moral something, tempered under the heat of the furnace of religion and hammered at the anvil of the heart under the beat of cultured rationality, as such a true marriage is an asset for the attainment of perfection.
(বিবাহ সমাজের সনাতন কোন সুবিধা নয়। তবে এটি একটি নৈতিক বিষয়, যা ধর্মীয় চুল্লীর উত্তাপের (অনুশাসনের) মিশ্রণে উষ্ণায়িত এবং হৃদয়ের যৌক্তিক সাংস্কৃতিক লয়ে পরিশীলিত। এই ধরণের একটি সত্যিকার বিবাহ পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ।)
আমরা দেখতে পাই বিয়েকে তিনি Marriage না বলে Wedlock বলেছেন। আমরা জানি lock অর্থ তালা। যা আমরা গৃহে, অফিসে, দোকানে প্রভৃতি স্থানে ব্যবহার করি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তদ্রুপ বিয়ে হচ্ছে এমন একটি প্রথা যা নারী–পুরুষ দু’জনকে একত্রিত করে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। যেখানে সে নারী শুধু ঐ পুরুষের ভোগ্যা, অন্য কারো নয়। ১৯৩৭ সালের ১০ অক্টোবর জনাব আবদুল জলিল তাঁর বন্ধুপ্রতীম ভাগ্নের বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে এই অমোঘ বাণী লিখেছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার শক্তিশালী পথনির্দেশনা। নীতি–নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের মিশেলে নারী পুরুষের বৈধ মিলনের এক চমৎকার দলিল।
বিভিন্ন জাতি–ধর্ম গোত্রের বিয়ে–সংস্কৃতি আলাদা। সাধারণত ধর্মীয় রীতি অনুসরণপূর্বক যে বিয়ে হয় তা সর্বোচ্চ বৈধ বিয়ে। আবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হলফনামা দিয়ে এক প্রকার বিয়ে হয় যা কোর্ট ম্যারেজ নামে পরিচিত। এর বাইরে এক ধরণের বিয়ে আছে যা সাধারণত সিনেমা নাটকে দেখা যায়। প্রেমিক–প্রেমিকা নদীতীরে বটবৃক্ষের শীতল ছায়ায় বসে বলে থাকে-‘সাক্ষী থাইকো বটবৃক্ষ/সাক্ষী গাঙের পানি/দেহ–প্রাণ দিছি তারে স্বামী বলে মানি’। তবে একটি বিষয়ে সবাই ঐক্যমতে পৌঁছে যে, সম্মতি ছাড়া কোন পুরুষ কোন নারীকে জোরপূর্বক ভোগ করতে পারবে না। এরকমটি হলে তা ধর্ষণ বা রেপ এর আওতায় পড়বে। যা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমন কি আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে বসবাসকারী উপজাতীয়দের মধ্যেও ধর্ষণ একটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আরবে ধর্ষণের শাস্তি পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ইদানিং আশংকাজনকহারে বেড়ে চলেছে। একাধিক সন্তানের জননী হতে তিন বছরের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানমতে বাংলাদেশে গত ২৭ মাসে ৮,৪৬৩ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালে ৩,৯৩০টি, ২০১৬ সালে ৩,৭২৮টি এবং এবছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৮০৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ পরিসংখ্যান রাজধানী, জেলা–উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত। বর্তমানে সারা দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রায় লক্ষাধিক মামলা ঝুলে আছে। বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩.৬৬ শতাংশ মামলা। এ সব মামলায় সাজার পরিমাণ ১% এরও কম। পরিসংখ্যানের বাইরে লোকলজ্জা, সামাজিক প্রভাব ও প্রভাবশালীদের হুমকিতে আরো কত ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায় তার হিসাব কেউ রাখে না। তবে নারী–পুরুষ স্বেচ্ছায় মিলিত হলে তা অনাচার–পাপ–অনৈতিক বলে বিবেচিত হবে। এটি প্রচার বা প্রকাশ হয়ে পড়লে তা নিন্দনীয়, ক্ষেত্রবিশেষ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজধানীতে ইদানিং লিভ–টুগেদার নামক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কথা শোনা যায়। শোনা যায়–সমকামীতার মতো জঘন্য পাপাচারের কথা এবং তার স্বপক্ষেও সরব সহানুভূতি! এছাড়া পরকিয়া পাপাচার আজ শহর–বন্দর–গ্রাম সর্বত্রই। অনৈতিক এ সম্পর্কের বলি হচ্ছে নারী–পুরুষ–শিশু। কোন কোন ক্ষেত্রে তা হত্যা অবধি গড়াচ্ছে। আমাদের সমাজ–সংস্কৃতি–ধর্ম কখনোই এসব অনুমোদন দেয় না। ইসলামী সমাজে বিয়ে ব্যতিত কোন নারী–পুরুষ স্বেচ্ছামিলিত হলে তা ব্যভিচার বা জেনা নামক মহাপাপ হিসেবে গণ্য এবং এতে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। পবিত্র ধর্ম ইসলামে নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে এবং নারীর অধিকার সর্বোতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও নারীরা আজ সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে আসীন। নারীর ক্ষমাতয়নে বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মডেল। সেই বাংলাদেশে খোদ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনা ঘটেছে–জাতি হিসেবে আমাদের তা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখ ও লজ্জাজনক আর কিছু নেই। কিন্তু কেন এমন ঘটনা ঘটছে? সমাজ গবেষক/নিরাপত্তা গবেষক কারো কোন মন্তব্য নেই। আসলে মন্তব্য করার মতো তেমন কোন ভাষা কারোর কাছেই নেই। মধ্যরাতে একাকী গভীর অরণ্যে বিষধর সাপ, জীব–জন্তুর হামলার আশঙ্কা থাকে এটা কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। স্বাভাবিক নিরাপত্তাবোধ থেকেই তা অনুভূত হয়। সেদিন বনানীর হোটেল রেইনট্রি কোন হোটেল ছিলো না, সেটি ছিল এক গভীর অরণ্য, সেখানে সাফাত, সাকিফ, নাঈম, বেলাল ও রহমত নামক যুবকেরা মানুষ ছিলো না, ছিলো হিংস্র হায়েনা। তাই যা ঘটবার তাই ঘটেছে। মেয়েগুলোর কাকুতি–মিনতি, আর্তচিৎকার কেউ কানে নেয়নি। পশুরা মানুষের কথা বোঝে না। তারা ভয় পায় মানুষের হাতের অস্ত্রকে। মেয়েগুলোর হাতে কোন অস্ত্র ছিলো না। মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। তাই বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ঘটনার বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। বরং খুঁজতে হবে ঘটনার পেছনের ঘটনাকে। কী করেনি তারা? দলবদ্ধভাবে উপর্যপুরি ধর্ষণ–শারিরীক নির্যাতন–ভিডিও চিত্র ধারণ এবং সর্বশেষে ফিনিশিং টাচ হিসেবে জোরপূর্বক জন্মনিরোধক ট্যাবলেট সেবন করানো। কোন ফাঁক ফোকর রাখা যাবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে ঐ মেয়েগুলোকে ক্রীতদাসী বানানোর শান্তিপূর্ণ সমাধান! যখনই ডাকবো, তখনই আসতে হবে। আমাদের আহবান–আদেশ অবহেলা করে এমন শক্তি–সাহস এদেশে কারোরই নেই। আমরা ক্ষমতাবান–অর্থে–বিত্তে–রাজনীতিতে–প্রশাসনে। তাই তো বনানী থানার ওসি মামলা নিতে গড়িমসি করে। পুলিশ কর্মকর্তার বদলে পালন করে উপদেষ্টার ভূমিকা। কিন্তু প্রশ্ন–কেন সাফাত–সাকিফ–নাঈম এত শক্তিশালী? এত ক্ষমতাবান? এত নির্ভিক? তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? বাংলাদেশ আজ নব্যধনীদের অপসংস্কৃতির অবাধ লীলাভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সর্বত্রই তাদের বলগাহীন দাপট। একটি স্বাধীন দেশে এটি কোন ক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা–বোনের ইজ্জত–আব্রুর বিনিময়ে আমরা এ দেশ চাইনি। সময় এসেছে এদের কঠোর হাতে দমন করার। অন্যদিকে আমাদের মেয়েগুলোরও কি হয়েছে? মধ্যরাতে বন্ধুর জন্মদিনে হোটেলে যেতে হবে কেন? কত দিনের বন্ধুত্ব ছিলো? বন্ধুত্বের প্রাথমিক পরীক্ষায় কি তারা উত্তীর্ণ হয়েছিলো? নানা প্রশ্ন। মেয়েগুলো যাওয়ার সময় কি পিতা–মাতা অভিভাবককে বলে গিয়েছে? কোথায় যাচ্ছি–কখন ফিরব। রাত যখন আরো গভীর হলো পিতা–মাতা কি তাদের খোঁজ নিয়েছেন? পুলিশকে জানিয়েছেন? ইত্যকার নানা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। পাশ্চাত্যের উগ্র সংস্কৃতির অন্ধ–অনুকরণ ও প্রযুক্তির সহজ প্রাপ্যতা ও অপব্যবহার হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমাদের তরুণ যুব–সমাজকে কে রক্ষা করবে–তার কোন উত্তর কেউ দিতে পারছে না। আবার এসব নিয়ে লেখা–লেখিতে ঝুঁকিও আছে। আমাদের দেশে ইদানিং একধরণের নারীবাদী, প্রগতিবাদী এক্টিভিস্ট লেখিকা রয়েছেন যারা বাংলাদেশকে সব সময় নারী নির্যাতনের একটি মডেল হিসাবে দেখাতে তৃপ্তিবোধ করেন। এর সাথে পুরুষনামধারী এক ধরণের নারী রয়েছেন যারা যৌক্তিক–অযৌক্তিকভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ না করে একতরফা মতামত দিয়ে থাকেন। তাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে। উৎপাদন, উন্নয়ন, কর্মমুখর একটি গতিশীল সমাজ–রাষ্ট্রে অপরাধবৃত্তিও সমান তালে চলে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তা নিবৃত্ত করা। সরকার এক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গীতৎপরতা থেকে শুরু করে সকল অপরাধেরই বিচার হচ্ছে–শাস্তি হচ্ছে। তবু কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কোন কোন অপরাধের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে–অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে এ সমাজ–রাষ্ট্রে বিচারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে ধর্ষিতা মেয়েসহ অসহায় পিতা ট্রেনের নীচে আত্মাহুতি দেন। এ নীরব প্রতিবাদ ও আত্মত্যাগের ভাষা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। জনগণ চায় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ মারাত্মক অপরাধের বিচার সর্বোচ্চ কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি, বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা দ্রæত নিশ্চিত করা। পৃথিবীর সকল দেশেই অপরাধ ঘটে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু প্রয়োজন–অপরাধ দমনে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের দক্ষতা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি। প্রভাবমুক্ত হয়ে ত্বড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ। এছাড়া দ্রুততম সময়ে বিচার কাজ সম্পন্ন করা। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা সব সময়ে অপরাধীর পক্ষে যায়। এটা নিরসন আজ সময়ের দাবী।
নারী–পুরুষের কাছাকাছি যাওয়া কখন নিরাপদ–কখন অনিরাপদ এটা নিজেকে স্থান–কাল–পাত্র বিবেচনায় বুঝে নিতে হবে। নারীকে বৈধ–অবৈধভাবে ভোগ করার প্রবণতা সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি সমভাবে দৃশ্যমান। তাই নারী–পুরুষের অবৈধ যৌন সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠানিকরূপ দিতে এক সময়ে জন্ম নেয় পতিতাবৃত্তি নামক এক নতুন পেশা। এক সময়ে যারা একবার ধর্ষিতা হতো তারা সমাজ সংসারে ফিরে না এসে পতিতালয়ে যেতে বাধ্য হতো। আবার কেউ কেউ বেঁচে থাকার তাগিদে বিকল্প জীবিকা হিসেবে পতিতাবৃত্তিকে বেছে নিতো। অনেককে জোরপূর্বক ধরে এনে, অপহরণ করে পতিতালয়ে আটকে রাখা হতো। এই আদিম পেশা আজ সারা বিশ্বে বিস্তৃত। কোন রাষ্ট্রই এটাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারেনি।
নারীকে নিরাপদ রাখার জন্য দেশের আইন–কানুনই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। একই সাথে ধর্মীয় অনুশাসন পালন এটাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে পারে। পরিবারকেও আরো সচেতন হতে হবে। গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসানো সব সময়ই বিপদজনক। যে দেশে নারীর অবমাননার শাস্তি যত কঠিন এবং দ্রুত প্রয়োগযোগ্য, সে দেশে নারী তত নিরাপদ, নারী নির্যাতন তত কম। আরব দেশগুলো তার প্রমাণ। আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে কৌটিল্যের জমানায়ও কোন পুরুষ যদি কোন গণিকাকেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলাৎকার করতো, সে ক্ষেত্রে পুরুষের কঠিন শাস্তি ও বিপুল জরিমানার বিধান ছিলো। আজ আমাদের প্রয়োজন নারী–শিশুসহ জনগণের জান–মান–ইজ্জত–আব্রু–সম্পদ–সুনাম রক্ষার্থে কঠোর আইন এবং তার দ্রুত প্রয়োগ। আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশ হতে উচ্চ আয়ের দেশে দ্রুত বেগে ধাবিত হচ্ছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম–বেশী দৃশ্যমান, যখন আমাদের মেয়েরা হিমালয় জয় করে, আমাদের মাশরাফি–মুস্তাফিজ–সাবিকরা বিশ্ব ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ায়, দারিদ্র বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিশুমৃত্যুসহ যখন আমাদের অর্জন বিস্ময়কর, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যখন আমার প্রধানমন্ত্রী বিশ্বস্বীকৃতি পান, ঠিক তখন সাফাত–সাকিফ–নাঈম গংদের সীমাহীন ঔদ্বত্য, দম্ভ আমাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দেয়। আমরা আর একটিও রেইনট্রি হোটেল বাংলাদেশে দেখতে চাই না। বাংলার মুক্ত ভূমিতে কখনো এদের অবাধ বিচরণ দেখতে চাই না। এরা পশু। এদের স্থান হবে জঙ্গলে–কারাগারে। যত ক্ষমতাবানই হোক, আইনের আওতা থেকে কেউ যেন পার না পেতে পারে।
রেইনট্রি হোটেলের ঘটনার এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি চাই যাতে আগামিতে বাংলার বুকে আর কোন সাফাত–সাকিফ–নাঈম জন্ম না নেয়। নারীর প্রতি সহিংস হবার সাহস যেন কেউ না দেখায়। আমাদের নারী–শিশুরা যেন ঘরে–বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, মাঠে–ময়দানে, দিনে–রাতে সর্বত্রই নিরাপদ থাকে।
লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা