টরোন্টোতে সবজি বাগান করার জন্য অনেকের বেশ উন্মাদনা জাগলেও প্রকৃত সৃষ্টিশীল কাজের জন্য যে পরিমাণ যত্ন, পরিশ্রম, সাধনা আর পরিশীলতার দরকার, তার অভাবই তাদেরকে বাগান করার শখ থেকে পিছিয়ে দেয়। কথা হলো লেগে থাকলে ভালো ফসল হবেই। এবারের জানার বিষয় লাউয়ের চাষ । লাউয়ের বৈজ্ঞানিক নাম Lagenaria siceraria, এটি Cucurbitaceae গোত্রের একটি জনপ্রিয় সবজি ফসল। গাছ লতানো, পাতা সরল ও একান্তর, বোঁটা লম্বা এবং ভেতরে ফাঁপা থাকে।
লাউ নিয়ে কথকথার শেষ নেই।
১। রতনে রতন চেনে ভোমরা চেনে মধু , ইস্টিমারের সারেং চেনে চিংড়ী মাছ আর কদু।
২। উঠান ভরা লাউয়ের মাচা ,গৃহস্থের ঘরে লক্ষ্মীর দশা।
৩। লাউ খেয়ে খুশী সবাই , খুশি বাংলার বধু , কচি লাউ শোল মাছে , লাগে যেন মধু।
৪। আফ্রিকাতে জন্ম তবে ছিল না কদর , ভেসে ভেসে বাংলায় এলো ঘরে ঘরে আদর।
৫। লাউয়ের গুনাগুন নিয়ে আছে নানা মত , ডাক্তার বলে লাউ হলো সব রোগের ঔষধ।
৬। কানাডাতে গাছ হয় লাউ যায় মরে , কৃত্রিম পরাগায়নে লাউ বেশি ধরে।
কথকথা যাই হোক, লাউ এবং লাউ পাতা আমাদের একটি জনপ্রিয় পুষ্টিকর সবজি। বড় সাধের এই স্বাদের লাউ। খাদ্য থেকে বাদ্য সবক্ষেত্রেই লাউয়ের ব্যবহার হয়ে থাকে। ডাল দিয়ে , ডিম্ দিয়ে , চিংড়ি, শোল, ইলিশ, শিং, মাগুর দিয়ে লাউ ও লাউয়ের তরকারীর তুলনাই হয়না। লাউশাক ভর্তা, আলু দিয়ে লাউখোসা ভাজি, লাউখোসার চচ্চড়ি, মোরব্বা, দুধ লাউ বা লাউয়ের ক্ষীর আরো কত কি ব্যবহার আছে লাউয়ের। টরন্টোতে লাউয়ের চাষ খুব সহজেই করা যায়। এখানকার মাটিও লাউ চাষের উপযোগী। ঠিকমত করতে পারলে ফলনও হয় প্রচুর। বাড়ির পিছনের আঙিনায় বা সিটি কর্পোরেশনের প্লট নিয়ে আপনি এই সবজি চাষ করতে পারেন। টরন্টোতে বাংলাদেশী দোকানে এর বীজ পাওয়া যায়।
এতে প্রচুর খনিজ ও ভিটামিন আছে। গবেষণার জানা যায় বাংলাদেশী সবুজ লাউয়ের জাত গুলোতে পরিপোষক অন্য লাউয়ের চেয়ে অনেক বেশি। বর্ণনা করলে পথ্য় হিসাবে এর উপকারিতা অনেক। যকৃতের ক্রিয়া স্বচ্ছন্দ রাখতে কাজ করে , চুল পাকা রোধ করে , চুল গজাতে সাহায্য করে , ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে , প্রস্রাব জনিত সকল ব্যাধির নিরাময় করে , আলসার হ্রাস ও রোধ করে , অত্যধিক – অমোঘ ব্যাধি হতে দেয়না , দাঁতের ক্ষয় রোধ করে , ওজন কমানোর মহৌষধ , মানসিক চাপ কমায় , হৃদরোগ প্রতিরোধ করে , শরীর ঠান্ডা ও প্রশান্ত করে , ত্বক মসৃণ করে , অনিদ্রা ও রক্তচাপ থেকে বাঁচায় , জন্ডিস রোগ আরোগ্য করে ইত্যাদি। লাউ, লাউয়ের ফুল শ্বেতি রোগ ও মুখের মেছতা দাগ তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
টরন্টোর আবহাওয়ায় তুলনামূলকভাবে জলীয় বাষ্প কম থাকায় বীজ খুব শুকিয়ে থাকে, ফলে বীজ গজানো মুশকিল হয়। বিশেষ করে লাউ এর চারা করতে বীজ ৫ থেকে ১০ দিন ভিজিয়ে রাখতে হয়। প্রথম দিকে বীজ পানিতে ভাসবে। বীজ ভিজলে পানিতে একটু গন্ধ হয়। সম্ভব হলে প্রতিদিন পানি বদলিয়ে দিন। একসময় বীজ পানির নিচে চলে যাবে। বীজ যখন পানির নিচে চলে যায় তখন , ভিজানো বীজ পানি থেকে উঠিয়ে কোন পুরাতন কাপড়, তোয়ালে বা পেপার তোয়ালেতে ভিজানো অবস্থায় পেঁচিয়ে, কোনো একটা স্বচ্ছ পাত্রে মুখ আটকিয়ে রেখে দিন। উল্লেখিত নিয়ম মেনে চেষ্টা করলে বীজ গজানো সহজ হবে। এভাবে অপেক্ষাকৃত একটু গরম স্থানে ৫/৭ দিন রাখার পর বীজ গজিয়ে যাবে। সময় বেশী লাগলেও চারা গজাবে।
এই গজানো বীজ চারা করার পটে পটিং মাটি দিয়ে ১ ইঞ্চি নিচে বীজের গজানো দিকটা নিচে দিয়ে পুতে দিতে হবে। ৩/৪ দিন পরেই চারা মাটির উপরে উঠে আসবে। মে মাসের ২১ তারিখের পর চারা মাঠে লাগানোর আগে একটু একটু করে ঠান্ডা ও রোদ সহনীয় করে নিলে ভালো হবে । তবে যদি আবহাওয়া ভালো থাকে এবং আপনার জমি তৈরী থাকে তাহলে ভিজানো বীজ সরাসরি জমিতে পুঁতে দিলেই হয়।
তবে মনে রাখতে হবে, আলো-বাতাস এবং তাপমাত্রা, লাউয়ের ভালো ফসল উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। লাউ পানিপ্রিয় সবজি তাই লাউয়ের ভাল ফলন পেতে হলে প্রচুর পরিমাণ সার আর পানির প্রয়োজন হবে। লাউগাছ প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে। তাই নিয়মিত গাছের গোড়ায় সেচ দেয়া, মাটির চটা ভেঙে দেয়া, বাউনি দেয়া, মাচা দেয়া ও মাচায় উঠার আগে পর্যন্ত গাছের গোড়ার শাখাগুলোও ভেঙে দেয়া বাঞ্ছনীয়। জমির আগাছা পরিষ্কার করার সময় মাটি আলগা করে দিতে হয়। তার ফলে গাছের গোড়ার মাটি নরম এবং ঝুরঝুরে থাকে। এতে গাছের গোড়ায় আলো-বাতাস সহজে প্রবেশ করে, গাছের খাদ্য গ্রহনের কাজটা ভালো হয়।গাছ যত বাড়ে ফলন তত বৃদ্ধি পায়। যখনই মাটিতে রসের অভাব দেখা দেবে, তখনই গাছের গোড়ায় পানি সেচ দেয়া উচিত। পানি সেচ বিকালে করা ভালো।
লাউয়ের ভালো ফলন পেতে হলে আপনাকে কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হবে। লাউয়ের কৃত্রিম পরাগায়নের উপর পরবর্তীতে একটা লেখা দেয়ার চেষ্টা করবো।
টরন্টোতে লাউ ফসলে পোকা-মাকড় খুব একটা হয় না , তবে রোগ হয়। বিশেষ করে পাউডারি মিলউড রোগ হয়।। এ রোগে আক্রমণ করলে গাছের পাতায় পাউডারের মতো আবরণ দেখতে পাওয়া যায়।ধীরে ধীরে গাছের পাতা বাদামি রঙ ধারণ করে, পাতা কুঁচকে যায়।এ রোগের কারণেও লাউ লাল হয়ে মরে যায়। মাটিতে বেশি রস থাকলে এ রোগ বেশী হয়। এই রোগ দমনের ঔষধ বিষাক্ত বলে আপনি কিনতে পাবেন না। তবে নিচে উল্লেখিত পদ্ধতিটি আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
১ চা চামচ সয়াবিন তেল ও ১০/১২ ফোটা লিকুইড সোপ, যা আমরা খাবার পাত্র ধোয়ার জন্য ব্যবহার করি, ভালোভাবে মিশিয়ে ১ লিটার পানিতে দিতে হবে। এরপর ১ টেবিল চামচ পটাসিয়াম বাই-কার্বোনেট (বেকিং সোডা) ওই পানিতে দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে বিকালে ছিটাতে হবে। গাছের বয়সের তারতম্যের উপরের মিশ্রণ উপাদানের কম বেশি করা যেতে পারে। এতে রোগ কিছুটা প্রতিরোধ হতে পারে তবে পরিপূর্ন রোগ দমনের নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। আক্রান্ত পাতা কেটে দিলে রোগ কমে যায়। আবার যদি পাতা, ডগা বেশী ঘন হয়ে যায় তবে তা কেটে বায়ু চলাচলের সুবিধা করে দিলে রোগ কম হবে।