সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধের কোনো একটা শনি বার সন্ধ্যা । হটাৎ উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেরিয়ে পড়লাম টরন্টোর বাংলাদেশীদের প্রাণকেন্দ্র , ডানফোর্থের উদ্দেশে। কোথায় বা কার কাছে যাচ্ছি , ঠিক নাই। মনে মনে ভাবলাম অন্তত দাদার সাথে দেখা হবে, দাদা ওরফে স্বপন সরকার । তাতেই চলবে , শুধু আড্ডা মারাই তো উদ্দেশো। বউ বাপের বাড়ি গেছে , আড্ডার জন্য উত্তম সময়। ডানফোর্থ পৌঁছে সরকার ফুডে ঢুঁ মেরে দাদাকে পেলাম না। তাহলে কি এই আধা ঘন্টার ড্রাইভিং বেকার যাবে। ফোনে করলাম, আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন “ডাউন টাউনে এসেছি, আধা ঘন্টায় ফিরবো। আমার জন্য অপেক্ষা করেন। ” এতো দূর থেকে অসার পর খালি ফিরে যাবার ইচ্ছা ছিল না। তাই অপেক্ষা করলাম। সরকার সাহেব নির্ধারিত সময়ের পরেই আসলেন। বললেন কারো জন্য খাবার আর গ্রোসারি শপিং দিতে গিয়ে ছিলেন ডাউন টাউনে। কৌতূহল বাড়ায় প্রশ্ন করতে উনি উত্তর দিলেন , ” বাংলাদেশ থেকে আসা একজন Acid Victim কে খাবার সরবরাহ করতে গেছিলাম “. কৌতূহলের মাত্রাটা অনেকটা ধাপ বেড়ে গেল। বললাম ” বাংলাদেশী Acid Victim এখানে কি জন্য ?” যে উত্তরটা পেলাম তা গা শিউরে ওদের মতো। ভালোবাসে স্বামী তার স্ত্রীকে Acid পান করিয়েছেন। তখনি সিদ্ধান্ত নিলাম , দেখা করবো ওই মেয়েটির সাথে। দাদাকে বললাম তার ব্যবস্থা করার জন্য।
পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী গতকাল রাত আনুমানিক সাড়ে নয়টায় পৌঁছে গেলাম টরন্টো ডাউন টাউনের অভিজাত এলাকায় , Elm Street এ। নিচের লবিতে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো মা আর মেয়ে। পপি রানী দাশ, বয়স ২৮। বাড়ী কিশোরগঞ্জ জিলার বাজিত পুর উপজিলায়। একটি অত্যান্ত গরীব ঘরের একমাত্র কন্যা সন্তান। সে তার বাবাকে কোনোদিন দেখে নাই ,তার জন্মের আগেই তার বাবার মৃত্যু হয়। তার মা ভাগলপুর উপজিলার জহুরুল ইসলাম হসপিটালে ছোট খাটো একটা কাজ করে সংসার চালাতেন আর সেই সাথে নিজের মা-বাবাকেও ভরণ পোষণ আর ব্যবস্থা করতেন। এক কোথায় বলতে গেলে অভাবের সংসার। মা অনেক কষ্ট করে মেয়েকে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ান। পপিও মায়ের সাথে একই হসপিটালে সহকারী টেকনিসিয়ান আর কাজ নেয় । পপি আর তার মা থাকতো খালা বাড়ীতে। ভালোই চলছিল মা আর মায়ের সংসার।
কিন্তু হটাৎ করে পরিবর্তনের হাওয়া লাগলো পপির গায়ে। তার প্রতিবেশীর ছেলে প্রদীপ বণিক , সিলেটের সুনামগঞ্জ থেকে প্রায়ই বেড়াতে আসতো তার মাসির বাড়িতে। এখানেই মিলন হয় চার চোখের – কাছে আসে একে অপরের। কেটে যাই দুইটি বছর। প্রদীপ তখন বিয়ের প্রস্তাব দেয় পপিকে। পপি জানতো প্রদীপের বাড়ীর লোকেরা এই বিয়েতে রাজি নয়। তাই সে প্রদীপকে বললো তার পরিবার থেকে সম্মতি এবং বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু প্রদীপের পরিবার এই বিয়েতে রাজি নয় , তখন সে পপিকে নিজেরা বিয়ে করে প্রস্তাব দিলে পপি সেই প্রস্তাবে রাজি হয় না। এই ভাবে কাটে যায় প্রায় একমাস। প্রদীপ পপিকে আত্মহত্যার হুমকি দিলে , শেষ পর্যন্ত পপি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যায় । ১৩ই জানুয়ারী ২০০৯ এ দুজনে প্রথমে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে এবং পরে মন্দিরে গিয়ে প্রচলিত হিন্ধু ধর্ম মোতাবেক বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে। দুজনে উপস্থিত হয় পপির মায়ের কাছে , নিজের অমতে হলেও মা দুজন জনকেই ঘরে তুলে নেন। কিন্তু প্রদীপের পরিবার এই বিয়ে মেনে নেয় না। বিয়ের কিছুদিন পর থেকে প্রদীপ টাকার জন্য পপিকে চাপ দিতে থাকে , অবস্থার পরিপেক্ষিতে পপি এবং তার মা বাধ্য হয়ে প্রদীপকে ব্যবসা করাকে জন্য ২ লক্ষ টাকা দেন। পরে জানা যায় প্রদীপ ওই টাকা দিয়ে কোনো ব্যবসা করে নাই। সে তাকে বোনের স্বামীকে বিদেশ যাবার জন্য ওই টাকা দিয়েছে। সে আবারো পপিকে টাকার জন্য চাপ দিয়ে থাকে। পপি তার শেষ সম্বল ৫০০০০ টাকাও তুলে দেয় স্বামীর হাতে। তাছাড়া পপি তার আয়ের সব টাকাই তুলে দিতো স্বামী প্রদীপের হাতে। প্রদীপ সেই টাকা দিয়ে নেশা করতো আর জুয়া খেলতো। হাপিয়ে ওঠে পপি , মুক্তি চায় সে প্রদীপের কাছে। প্রদীপ তাকে ছাড়তে রাজী না , যখন পপি বার বার তাকে ছেড়ে দিবার জন্য চাপ দিকে থাকে তখন প্রদীপ তাকে এই পৃথিবী থেকে মুক্তির দিবার সিদ্ধান্ত নেয় ।
৭ই সেপ্টেম্বর ২০০৯। শরীরে জ্বর নিয়ে সেই দিন পপি কাজে যায়.. কাজ শেষে দেখে প্রদীপ এসেছে তাকে নেয়ার জন্য। খুশি হয় পপি , অসুস্থথার জন্য ঘরে ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে সে। রাত্র আনুমানিক দশটা , তৃষ্ণায় তার ঘুম ভাঙে। পানি চায় স্বামীর কাছে। অন্ধকার ঘরে প্রদীপ তার হাতে তুলে দেয় acid এর গ্লাস। পানি মনে করে এসিডের গ্লাসে চুমুক দেয় পপি। মুহূর্তের মধ্যে মুখ থেকে শুরু করে পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছে যায় অগ্নিয়গিরির লাভার মতো অ্যাসিড। হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে যায়। জ্ঞান হারায় পপি। কয়েক দিন পর জ্ঞান ফেরে তার , তার পরিচিত নিজের কর্মস্থল জহুরুল ইসলাম হাসপাতাল। তখন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে লড়ছে একটি প্রাণ। কিন্তু এখানে তার চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। ডঃ প্রাণ গোপাল সাহার সহায়তায় তাকে ঢাকা বক্ষ্য-ব্যাধী হসপিটালে আনা হয় , সেখানে সে ডাঃ রাজ্জাকের চিকিৎসধীন ছিল অনেক দিন। পরে সেখান থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তাকে অ্যাসিড সারভাইভার ফাউন্ডেশনে স্থান্তরিত করা হয়। সেখানে তার একাধীক অরেশন হয়। কাটতে থাকে একটা অনিশ্চিত জীবন। কেটে যায় সাতটি বছর।
গত বছর কানাডিয়ান একটা মেডিকেল টীম বাংলাদেশে যায় অ্যাসিড ভিকটিমদের উপর গবেষণার উদ্দেশে। সেখানেই পপির সন্ধান পান টরন্টো জেনারেল হসপিটালের Dr Toni Zhong। বিশ্বের প্রথম Survivor (অ্যাসিড খাবার পর বেচে যাওয়া) হিসাবে Dr Toni পপিকে টরন্টো নিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। কানাডাতে ফিরে আসার পর উনি পপিকে তার মা সহ টরন্টোতে নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা করেন ।
১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৭, পপি পৌঁছে গেল নতুন ঠিকানায়। প্রথমে পপি বাংলাদেশী কমুনিটির সহায়তায় একটা বেসমেন্ট ভাড়া করে থাকত। কিন্তু তার প্রথম অপেরেশনের পর ডাক্তাররা বুঝলেন বেসমেন্টের ঠান্ডা আবহাওয়া তার জন্য এই মুহূর্তে ক্ষতিকর। তখন টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল তার জন্য থাকার ব্যবস্থা করলো। পপি এখন থাকে Elm Street – Bay আর Elm Street আর সংযোগ স্থলে। এই দায়িত্ব টুকুও পালন করলো টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল। কানাডা আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার পাকস্থলী সহ শরীরের ভিতরের অংশে ৪টি অপারেশন করা হয়েছে। এত দিন সে তার গলা আর পেটে ছিদ্রের মাধ্যমে পাইপ দিয়ে তরল খাবার খেত। গত ২ সপ্তাহ হোল দীর্ঘ ৭ বছর পর সে “সলিড” খাবার খাচ্ছে। আস্তে আস্তে তার মুখের স্বাদ ও ফায়ার এসেছে। Dr Toni আর তার টীম পপিকে নিয়ে এখন অনেকটা আশাবাদী। হয়তো একদিন সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। ফিরে যাবে তার আগের জীবনে।
পপির বর্তমান অবস্থাতে টরোন্টোতে থাকতে হলে ৩টি জিনিসের বড় প্রয়োজন। চিকিৎসা ,বাসস্থান , অন্ন -প্রথম দুটির ব্যবস্থা করছে টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল । বাকি থাকে একটি -দৈনন্দিন জীবনে চলার জন্য একটা অর্থনৈতিক সাহায্য। গ্রেটার টরন্টো এরিয়াতে আমাদের প্রায় “৫০০০০ বাঙালির একটা পরিবার।” আমরা কি পারিনা একটু সাহায্যের হাত বাড়াতে? স্বপন দাদা বা তার মতো ১ বা ২ জন যে কাজটি করেছ আমরা কোনো তাদের পাশে দাড়াইনা ?
লবিতে বসে কথা বলার সময় জিজ্ঞাসা করলাম তোমার কোনো অভিযোগ আছে কি না ? উত্তরে শুধু বললো ” জীবনে আমি যা হারিয়েছি তার চাইতেও বেশি পেয়েছি এই অচেনা দেশে , আমি শুধু ফিরে যেতে চাই আমার নিজের জীবনে। আমার আগের কর্মস্থল জহুরুল ইসলাম হাসপাতাল। ”
একটি মানুষ যার চাওয়াটা অনেক অল্প – তার জন্য করার মতো কি আমাদের কিছুই নাই ?
উত্তরের ভারটা আপনাদের উপর।
যদি কেউ পপিকে সাহায্য করতে চান। নিম্ন লিখিত ব্যাক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
স্বপন সরকার :-416-464-4193
হিমু ভাই :- সরকার ফুডস
অরুন দত্ত :- 647 267 6564