মানুষের মন বিচিত্র! নতুন করে এটি প্রমাণের দরকার নেই। করোনাকালে গৃহবন্দী হওয়ায় কথাটি আবার মনে পড়ল। বিশেষ যে কারণে কথাটি মনে পড়ল তা হলো “ওয়ার্ক ফ্রম হোম”। বাসা থেকে অফিস করার সুবিধাটি সবচে’ আনন্দদায়ক হওয়ার কথা। কিন্তু মাত্র একমাস “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করে মনে হচ্ছে হাঁপিয়ে উঠেছি। এক মাস আগেও যখন প্রতিদিন সকালের আরামের ঘুম হারাম করে অফিসে যেতে হতো কী যে কষ্ট লাগত! মনে হতো কেন প্রতিদিন সকালে ৯ টার মধ্যে অফিসে যেতে হয়? আহা! যদি বাসায় বসে অফিস করা যেত আর মাস শেষে বেতন পাওয়া যেত! আর এখন যখন করোনার সুবাদে “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করছি, শুধু মনে হয় আর কতদিন এভাবে বাসা থেকে কাজ করতে হবে।
আসলে বিষয়টি মনে হয় “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” হওয়ার জন্য নয়। মূল কারণ বন্দীদশা। কানাডার বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারের পক্ষ থেকে বারবার জনগণকে আদেশ-অনুরোধ করা হচ্ছে বাসায় অবস্থান করার জন্য। এ সকল আদেশ-অনুরোধ উপেক্ষা করা হলে, কোন কোন ক্ষেত্রে জেল-জরিমানার নিয়মও চালু করা হয়েছে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই আমার “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” সুবিধাটি এখন আনন্দের না হয়ে বেদনার হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে থাকতেই আমি “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” ধারণাটির সাথে পরিচিত হই। অবশ্য সে সময় হাতে গোণা দু’ একদিনের জন্য বাসা থেকে অফিসের কাজ করতে হয়েছিল। তখন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অফিসের সেই সুবিধাটি গ্রহণ করেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, আমার অফিসের এই সুবিধাটি সত্যিই অসাধারণ!
দ্বিতীয়বার “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” এর সুবিধাটি নিয়েছিলাম কানাডায় আসার পর। সৌভাগ্যবশতঃ আমার কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি আর লাইবেরিয়ায় “মানবাধিকার উপদেষ্টা” হিসেবে নিয়োগপত্র একসাথে পেয়েছিলাম। তখন আমার “শ্যাম রাখি না কূল” রাখি অবস্থা। আমার নিয়োগকর্তা ছিলেন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। তাদের সাথে দফা-রফা করে “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করার অনুমতি পেলাম। একমাস বাসায় বসে লাইবেরিয়ার জন্য কাজ করলাম। কানাডায় আমি তখন মুক্ত বিহঙ্গ। বাইরে যেতে এখনকার মত কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। করোনার ভয় নেই। নতুন দেশে এসেছি। এদেশেই একদিন স্থায়ী আবাস গড়ার ইচ্ছা। তাই লাইবেরিয়া যাওয়ার আগে কানাডাকে বুঝার চেষ্টা করেছি, দেখার চেষ্টা করেছি। সেজন্য “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” এর সুবিধাটি একটি বড় পাওয়া হিসেবে মনে হয়েছিল সে সময়। এখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে একমাস পর লাইবেরিয়ায় উড়াল দিলাম।
লাইবেরিয়া যাওয়ার প্রায় এক বছর পর দেখা পেলাম এক মহামারির। ২০১৪ সালের সেই মহামারির কথা আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে। আমার পরিবারসহ আমি তখন সেখানে। ইবোলা’র প্রাদুর্ভাব হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে মহামারির আকার ধারন করল। এখনকার করোনার মতো ভয়ংকর এক পরিস্থিতি লাইবেরিয়া ও তার আশে পাশের দেশগুলোতে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে আমরা বাংলাদেশে চলে গেলাম। তৃতীয়বারের মত “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করার সুবিধা পেলাম। তখন বাংলাদেশে কিছুদিন থাকলাম এবং তারপর কানাডায় চলে আসলাম। সে সময়টাতে প্রায় ৬ মাস “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” করলাম। খারাপ লাগেনি। বরং এরকম সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে।
কিন্তু এবারের “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” সুবিধাটি আনন্দের না হয়ে কষ্টের মনে হচ্ছে। প্রতিদিন খবর শুনি। দেখি কোন সুসংবাদ পাই কিনা। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না। সরকারের ঘোষণার অপেক্ষায় আছি। কবে আবার সব কিছু খুলে দিবে। কবে আবার অফিসে যেতে পারব। কবে আসবে সেই সুদিন?
টরন্টো / এপ্রিল ১৯, ২০২০