একটি পসিটিভ সংবাদ দিয়ে শুরু করি। আমেরিকার ১৭টি স্টেট্ আজ ২৭ জুন ২০১৮ ট্রাম্প এডমিনিস্ট্রেশনের সাম্প্রতিক গৃহীত বাচ্চাদেরকে তাদের রেফিউজি পিতামাতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। গতকাল ক্যালিফোর্নিয়ার একজন বিজ্ঞ ফেডারেল বিচারক ডানা সাবরাজ ট্রাম্প প্রশাসনের এই কর্মকান্ডকে স্থগিত করার আদেশ দিয়েছেন। আপনাদের সবারই জানা আছে যে শুধুমাত্র মেক্সিকান মার্কিন সীমান্তই নয়, আমেরিকার সকল বর্ডারেই একই অবস্থা বিরাজমান। কানাডা আমেরিকা সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থী আমেরিকা থেকে কানাডা ঢুকে পড়ছে। অথচ, সিডেলা রোমান নামের একজন কানাডিয়ান জগিং করার সময় ভুল করে আমেরিকার সীমান্ত ক্রস করে ফেলে। ফলে তাকে বন্ধ ট্রাকে করে দুই ঘন্টা ড্রাইভ করে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাকে দুই সপ্তাহ কারারুদ্ধ থাকতে হয়।
প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের মেক্সিকান বর্ডারে অভিবাসী প্রার্থীদের সন্তানদেরকে জোর পূর্বক তাদের মা–বাবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ডিটেনশন সেন্টার বা ফস্টার হোমে রাখছে : যা ভীষণ হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করছে। আট মাস বয়সী শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না এধরণের বিচ্ছিন্নতা থেকে। ডিটেনশন সেন্টারে শিশুরা যৌন নির্যাতন সহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। রিপাব্লিকান টেড লিউ ট্রাম্পের সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপকে মানবাধিকার লংঘন এবং আন্টি আমেরিকান আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন– এতে খোদ যীশুকেই আক্রমণ করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রাওয়াদ আলহোসেন ট্রাম্পের এই আদেশে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের ইউনিসেফের প্রধান জেনারেল হেনরিকেট ফোর এক বিবৃতিতে বলেন– শিশুদের নিরাপত্তার অধিকার আছে, তাদেরকে অমানবিক ভাবে মা বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা মানবাধিকার লঙ্ঘন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ, এমনকি ট্রাম্পের নিজের দল এবং তার স্ত্রী মেলানি ট্রাম্প তার এই অভিবাসন নীতিমালার বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা সবাই একযোগে বলছেন “সন্তানদেরকে তাদের পিতামাতার অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া অন্যায়।যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল এবং মে মাসের শেষের দিকে মার্কিন–মেক্সিকো সীমান্তেই প্রায় ২০০০ শিশুকে তাদের মা–বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এইসব শিশুরা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ট্রমার সম্মুখীন হচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন সম্প্রতি বাবা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তায় বলেন ” আমি ভীষণ ভাবে মর্মাহত। ” অপরদিকে ট্রাম্প বলেছেন তিনি আমেরিকাকে রেফুজিদের আড্ডাখানায় পরিণত হতে দিতে পারেন না। তিনি রিপাব্লিকানদেরই এরজন্য সম্পূর্ণ ভাবে দায়ী করেছেন। অভিবাসন প্রার্থীদেরকে তিনি ইল্লিগাল এবং ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়েছেন।
এখন আসুন তাহলে দেখা যাক আমেরিকার আইকনিক সিম্বল স্ট্যাচু অফ লিবার্টি যা কিনা স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক তার সঙ্গে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ইল্লিগাল ইমিগ্রেশন এর যোগসূত্রটা কোথায়? মাস্যাচিউটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর বিশিষ্ট ভাষাবিদ জীবন্ত কিংবদন্তী নোয়াম চমস্কি সদা সর্বদাই আমেরিকার যেকোনো অন্যায় এবং ভুল নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এসেছেন। ইউক্রেনের বংশোদভুত জুইশ এই স্পষ্টবাদী ভাষাবিদ ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি আমেরিকার যেকোনো সরকারের যেকোনো অন্যায়ের কড়া সমালোচনা করে আসছেন। তিনি ট্রাম্পের “আমিই প্রথম এবং একমাত্র” এবং “আমিই শ্রেষ্ঠ” পলিসিকে আমেরিকার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য “কমপ্লিট ডিসাস্টার” বলে আখ্যা দিয়েছেন। চমস্কির সুযোগ্য কন্যা অভিভা চমস্কি , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সালেম স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর তাঁর লেখা “আনডকুমেন্টেড: হাউ ইমিগ্রান্টস বিকেম ইল্লিগাল” ২০১৪ বইটিতে খুব চমৎকার ভাবে ইম্মিগ্রান্টদের প্রতি আমেরিকার আচরণকে তুলে ধরেছেন। স্লিন্টার ইউ টিউবে ভিডিওর মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে আমেরিকায় বিদ্যমান রেসিজম কেই তুলে ধরেছে । আদতে আমেরিকাতে অবৈধ ইমিগ্রেশন তো দূরে থাকে, ইমিগ্রেশন এরই কোনো আইন ছিল না। আমরা হয়তো অনেকেই আমাদের ইতিহাস বইয়ে পড়েছি– কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন ১৪৯২ সালে । কিন্তু তার অনেক আগেই আসলে ষোড়শ শতকের শুরুতেই ইউরোপিয়ানরা আমেরিকা আসা শুরু করে। প্রমাণ আছে ৬০০ সালেই একজন আইরিশ মঙ্ক প্রথম আমেরিকা আসেন, ভাইকিংরা আইসল্যান্ড থেকে আমেরিকা আসেন দশম শতাব্দীতেই। কলম্বাস ইউরোপকে আমেরিকার জন্য উন্মুক্ত করেন আর এজন্যই বোধ হয় আমেরিকা আবিষ্কারের সমস্ত ক্রেডিট তাকেই দেয়া হয়। একজন চাইনিজ ঐতিহাসিক দাবি করেন পনেরশ সালে চায়না আমেরিকাতে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছিল, যদিও এটি অনেকেই গ্রহণ করেন নি। তবে এটি প্রমাণিত যে সিস্টেমিক, সাকসেসফুল কলোনাইজেশন আমেরিকাতে প্রথম স্প্যানিশরাই করে, ১৫১৩ সালে। তারা প্রথমে মেক্সিকো দখল করে এবং তার পর আমেরিকা আসে। তবে তাদের পর পরই ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ এবং ডাচরাও আমেরিকার বিভিন্ন এলাকা দখল করে কলোনাইজেশন করতে থাকে। ইউরোপিয়ান সেটেলাররা নেটিভ আমেরিকানদের জায়গা জমি দখল করে নিজেদের দাবি করতে থাকলো, আফ্রিকানদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্লেভ শিপে করে আমেরিকা আনা হতে থাকে। আমেরিকা যখন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র কাঠামো তৈরী করা শুরু করলো , তখন তারা ইম্মিগ্রান্টদের সমান অধিকার, ন্যায়বিচার, সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার চটকদার প্রতিশ্রুতি দিতো। আর সেজন্যই ইম্মিগ্রান্টরা বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে আমেরিকা আসতে থাকে। সেই সময়ে আমেরিকান বর্ডার ছিল সম্পূর্ণ ভাবে খোলা। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি প্রমাণিত হতে থাকলো যে যারাই আমেরিকা এসেছিলো তাদের সবাইকে সমান ভাবে গ্রহণ করা হয় নি। নর্দার্ন ইউরোপ থেকে আগত এংলোসাক্সন প্রোটেস্টান্টরা দাবি করলো, তারাই প্রথম এসেছে, কাজেই তারাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। আইরিশ, ইটালিয়ান সহ আরো বেশ কিছু ইস্টার্ন এবং সাউথর্ন ক্যাথলিক ইউরোপীয়ানরা বিভিন্ন ভাবে ডিস্ক্রিমিনেশনের শিকার হতে থাকে। ১৭৯০ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম অভিবাসন আইন নাচারালাইজেশন একট চালু করেন। এই আইনে বলা হয় কেবলমাত্র হোয়াইট প্রোটেস্টান্টরাই আমেরিকার নাগরিক হতে পারবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই সস্তায় চাইনিজ শ্রমিক এবং ব্যাবসায়ীদের আনা শুরু করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকা প্রচন্ড অর্থনৈতিক মন্দ দেখা দিলে যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দেয়া হয় চাইনিজ অভিবাসীদের উপর– তারা নাকি আমেরিকার সমস্ত চাকরি নিয়ে নিয়েছিল। এজন্য ১৮২২ সালের চাইনিজ এক্সক্লেউশন একট চালু করা হয় ; ফলে প্রায় সব চাইনিজ দেরই আমেরিকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। এইসময় আমেরিকা ইউজেনিক্স প্রথা চালু করে যা রেসিজম এবং হোয়াইট সুপ্রিমেসির ই আর এক রূপ। এই পদ্ধতিতে ১৯২৪ সালে একটি কোটা প্রথা চালু করা হয়। এই কোটাতে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক বরাদ্দ ছিল নর্দান ইউরোপীয়ানদের জন্য, দ্বিতীয় অবস্থান বরাদ্দ ছিল দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপিয়ান দের জন্য, সব শেষে ছিল এশিয়ানদের কোটা। ১৯৬০ সালের দিকে আবারো আমেরিকা তাদের প্রয়োজনে এশিয়ান প্রফেশনাল ওয়ার্কারদের জন্য ইমিগ্রেশন ওপেন করে। ১৯৬৫ সালের ইমিগ্রেশন এন্ড ন্যাশনালিটি একট অনুযায়ী এশিয়ান প্রফেশনালরায় আমেরিকা আসতে পারছিলো কিন্তু এবার তারা বাদ দেয় ব্ল্যাক এন্ড ল্যাটিন আমেরিকানদের , তাদের উপর ইম্মিগ্রেশনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে রাতারাতি বহু মেক্সিকান এবং ল্যাটিন আমেরিকান মার্কিন সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল যারা বহু আগে থেকেই বৈধ ওয়ার্কার হিসাবে আমেরিকাতেই কাজ করছিলো। আমেরিকা ১৯৬৫ সালের ইমিগ্রেশন এন্ড ন্যাশনালিটি একট অনুসারে এক রাতে হাজার হাজার ব্ল্যাক এবং ল্যাটিন বৈধ শ্রমিকদের অবৈধ ঘোষণা করে। আর সেই ঘোষণার জের এখনো আমেরিকা বয়ে বেড়াচ্ছে। ট্রাম্পের আগমনে ঘৃতে অগ্ন্যাহুতি ঘটেছে। প্রফেসর আভিভা চমস্কি চমৎকার ভাবে লিখেছেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন– ইম্মিগ্রান্টরাও মানুষ– ওদের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো– তাঁদেরকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় যা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একদল মানুষকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তাদেরকে বঞ্চিত করা হোলে সেটি অন্যায়। তিনি তাঁর লেখা বইয়ে ১৯৮০ সালেই লেখেন, মানুষ কখনো ইল্লিগাল হতে পারে না আমেরিকার অভিবাসন আইনই ইল্লিগাল। প্রত্যেক মানুষকেই সমান অধিকার ভোগ করতে দিতে হবে। তিনি আরো বলেন আমেরিকার ইমিগ্রেশন আইনই আমাদেরকে বিভিন্ন গ্রূপে ভাগ করে দিয়েছে। কলমের একটি খোঁচায় ইললিগাল শব্দটি মুছে ফেলা দরকার যাতে আমেরিকাতে আমরা সবাই সমান মানবাধিকার ভোগ করতে পারি। ইমিগ্রান্টদের ভালো এবং খারাপ এই দুই ভাগে ভাগ করা একটি ভীষণ বিপদজনক খেলা। ক্লিনটন এবং ওবামা ট্রাম্পের জন্য এই খেলার ভিত্তি তৈরী করেছিল। এই বিপদজন রেসিস্ট খেলা অনতিবিলম্বে বন্ধ হয়ে উচিত।
মাহমুদা নাসরিন, আরসিআইসি & কমিশনার অফ ওৎস , ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, ২০৫/৩০৯৮ ডানফোর্থ এভিনিউ, শিক্ষক এবং সমাজকর্মী।