সমগ্র বিশ্ব গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নামে দুটি ব্লকে বিভক্ত। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে রয়েছে:
ক) চীন (সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ উভয় উপাদানের সাথে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা)
খ) কিউবা (রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন মাধ্যম)
গ) উত্তর কোরিয়া (সরকার মালিকানা এবং উৎপাদনের সমস্ত উপায়ের নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। ভিয়েতনাম এবং লাওস এই দুটি দেশ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে পরিচালনা করে।
ঘ) ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর রাশিয়ার জার দ্বিতীয় নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করেন ও কমিউনিজম বাস্তবায়নের প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা সংঘটিত হয়; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪৫) পর সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ : আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়া পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে এবং নিজেদের সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসাবে নাম পরিবর্তন করে। রাশিয়া ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত একটি কমিউনিস্ট মডেলের অধীনে ছিল। প্রথম দিকে কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা উৎসাহ দেখালে ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের টুকরো টুকরো সংস্কার শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ দেয়নি এবং অর্থনীতিকে দুর্বল করেছিল। ১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর, মিখাইল গর্বাচেভ প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট মডেলের সমালোচনা করেন এবং তাঁর শাসনামলে দেশের অনেক পরিবর্তন আনয়ন করেন। তবে রাশিয়ার রাজনীতি এবং অর্থনীতি এখনও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ এবং কর্তৃত্ববাদী প্লুটোক্রেসি / অভিজাততন্ত্রের মিশ্রণ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি এ দেশে তার উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
সঠিক নির্বাচনই কি একটা দেশের সব কিছু সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে ?
সঠিক নেতৃত্ব না থাকলে,কাগজে কলমে লেখা নীতি,বিনা প্রয়োগে দেশের মঙ্গল আনয়ন করতে অক্ষম। সঠিক নেতার মাধ্যমে সঠিক নির্বাচন দিয়ে দেশের জনগণকে ঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব।যদি সৎ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ; প্রথমে সৎ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ খুঁজে বের করতে হবে যাদের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাবে। এর পর জনগণের সদিচ্ছায় ভোটের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হলে,সে সব ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দেশের জন্য নিবেদিত ভাবে কাজ করে জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাবে। আপনি একজন লোককে নির্বাচন করলেন যার কোনো স্বপ্ন নেই, কি ভাবে নেতৃত্ব দেবে,সংসদে গেলেই হলো না, তাকে দেশের সমস্যা এবং সমাধান খুঁজে বের করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে । অযোগ্য ব্যক্তি দিয়ে দেশ পরিচালনা করা, সময়ের অপচয় মাত্র ।
বাংলাদেশে কত শ্রেণীর লোক বাস করে ?
১) দেশের পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার জন্য একটি শিক্ষিত,দক্ষ, মেধাবী,দেশ গোড়ার স্বপ্ন যার আছে,তাকে বা তাদের দায়িত্ব দিলে পরিশ্রম করে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে। অথচ এই শ্রেণীর লোক যাদের শিক্ষা ও যোগ্যতা আছে,সমাজে এক ধরণের লোকের ভিড়ে হারিয়ে যায়, কেউ তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করে না।
২) আর এক দল লোকের লেখাপড়া, কাজের দক্ষতা থাকলেও, সততার অভাব,স্বার্থপর, সুযোগ পাইলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজের কাজে লাগিয়ে রাতারাতি কেটে পরে , এদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে দেশের কোনো কাজ হয় না বা আকাঙ্খিত সু-ফল আশা করা যায় না।
৩ ) বাংলাদেশের ৮০% লোক গ্রামেগঞ্জে কৃষি ও শহরে নিম্ন মানের কাজ করে,এই সব লোকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না,দেশে অভাব,দুর্নীতি এদের অবস্থা খারাপ করে তুলে, এদের ভাগ্য নির্ভর করে ধনী, শিক্ষিত, দক্ষ সৎ লোকের ভালো কাজের উপর । বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোক বেকার, একজন কাজ করে দশ জনের সংসার পরিচালনা করে।
সৎভাবে ভোট দিলেও অসাধু উপায়ে ভোট কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় ও নির্বাচনকে অন্যায্য করা যেতে পারে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে বাংলাদেশে ভোট গণনা সঠিক হয় না। তাছাড়া ভোট লুকিয়ে রেখে ফলাফল ঘোষণা করা যা মূলত সঠিক ভোটের ধারেকাছে ও না। একমাত্র স্বচ্ছ জবাবদিহি নির্বাচনে নিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সৎ হলে তা রোধ করা যেতে পারে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে এবং নির্বাচনে কারচুপি রোধে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করা জরুরি।
আমাদের বাংলাদেশে নির্বাচন সঠিকভাবে হয় না,এ সম্পর্কে অনেক প্রমাণাদি রয়েছে। এ দেশে ভোট কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার চুরি এবং একজাতীয় অসৎ লোক সীল মেরে ভোট বক্সে ঢুকানর মতো ঘটনার প্রমান ও পাওয়া গেছে। জেলা/উপজেলা পর্যায়ে রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার সরকারি দলের মনোনীত হওয়ার কারণে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের মধ্যে নাড়িভুঁড়ি এতটাই শক্তিশালী যে নির্বাচনের পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থাপনা এড়ানো যায় না। সে জন্য বাংলাদেশের জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার জন্য বার বার শুনে আসছি এবং তার প্রমাণ ও রয়েছে।
নির্বাচনের সময় যখন স্পষ্ট অসঙ্গতি ঘটে তখন “কিছুই দেখবেন না, কিছুই করবেন না” এই মনোভাব গ্রহণ করার পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের প্রবণতা প্রমান করে যে ওরা মূলত সরকারের তাবেদার বা এতই দুর্বল যে প্রতিবাদ করার কোনো ক্ষমতা রাখে না। এই অসঙ্গতিগুলির মধ্যে বুথের মধ্যে ভোটারদের ভয় দেখানো, কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোটারদের কেন্দ্রে পৌঁছাতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি পর্যন্ত হতে দেখা গেছে, যা কোনো প্রকারেই প্রতিরোধ করা যায় না ।
সরকার সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ ও প্রতিশ্রুতি দেয়া প্রয়োজন যাতে সবাই ভোট প্রচার থেকে ভোট দেয়া পর্যন্ত সমান অধিকার পায় ; আমাদের দেশে বড় দলগুলি ছোট দলগুলির উপর অবিচার করে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, ছোট বা বড় প্রত্যেক দল যাতে প্রচারণার ন্যায্য সুযোগ পায়, ভোট কেন্দ্র যেন কোনো প্রকার অসুদুপায় অবলম্বন থেকে মুক্ত থাকে।
আমাদের অনুন্নত দেশগুলিতে নির্বাচনের দিন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে জনগণ, বিশেষত তরুণ ভোটাররা যারা বছরের পর বছর ভোট দেয়নি,আনন্দের সাথে তাদের ভোট দিতে পারে।
কানাডায় গত ১০০ বছরের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা, সততা এবং নিরাপত্তার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করেছে। এই ক্ষেত্রে নির্বাচন কানাডার সাফল্যের একটি মূল চাবিকাঠি হ’ল ভোটারদের শতাংশ নির্বাচনের প্রশাসন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। এখানে ভোটার এবং নির্বাচন এজেন্সির মধ্যে কোনোরকম দ্বন্দ্ব দেখা যায় না। ভোটাররা নিরাপদে,নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারে। নিরাপদ ভোটদান এবং গণনা ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য কানাডায় কঠোর আইন রয়েছে এবং এর ব্যতিক্রম নেই।
কানাডা নির্বাচিত সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যেমন অপরাধ এড়ানোর জন্য আইন বাস্তবায়ন, দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক স্থিতিশীলতার দিকে অবিচ্ছিন্ন মনোনিবেশ, যুবকদের অর্জিত জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়া, বিশেষ করে দেশের অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা, যাতে জনগণ সন্তুষ্ট হয়। এভাবেই কানাডার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সাফল্যের পথে এগিয়ে গেছে । নির্বাচিত সরকার কখনই আইনের ব্যর্তয় ঘটিয়ে এমন কিছু করবে না,এ দিক থেকে জনগণ সজাগ দৃষ্টি রাখে এবং প্রয়োজনে সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করে না ।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যে প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মতো গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে এবং পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। এ সব দেশে সরকার সঠিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হারিয়ে ফেলার কারণে দেশে প্রায়শঃই অভ্যুত্থান,পাল্টা অভ্যুথান দেখা দেয় এবং পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধের মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়।
সমাপ্ত