আমার বিরাট অপরাধ, আমি বেশি লোকজনের সাথে মিশতে পারি না, কারো সাথে পরিচিত হলেও ফলোআপ করি না ৷ অনেক যাচাই বাছাই করে ছোট্ট একটা নেটওয়ার্কের মধ্যেই আমার দৌড় ৷ সেই নিজস্ব ছোট্ট পরিচিত গন্ডির বাইরে কোনো গ্রুপের অনুষ্ঠান বা নিমন্ত্রনে খুব একটা যাই না ৷ এক আত্মীয় বললো যে অল্প কিছু লোককে দাওয়াত করা হয়েছে, কোনো রকম ফালতু আলাপ করার লোক এদের কেউ না, এইসব নানা রকমের ঘ্যান ঘ্যান করার পর রাজি হলাম তার ঐ পার্টিতে যেতে ৷ গিয়ে দেখি এক গাদা অপরিচিত লোক লিভিং রুমে বসে আছে এবং আরো অনেকের আসার অপেক্ষায় গৃহ কর্তা ঘন ঘন ঘড়ি করছেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন ৷ এতগুলো অপরিচিত লোকের মধ্যে বসে থাকতে যে খুব একটা খারাপ লাগছিলো তা না বরং সবাই মিলে সানরাইজার্সের (মুস্তাফিজের প্রথমবার) খেলা দেখতে ভালোই লাগছিল ৷ বিপত্তি শুরু হলো খেলা শেষ হবার কিছুক্ষন পর, ততক্ষনে আরো বেশ কয়েকজন সপরিবারে এসে যোগ দিয়েছেন ৷ ইনিশিয়াল হাই হ্যালো দিয়ে আইস ব্রেকিংএর পর যখন সবাই মোটামুটি নিশ্চিত যে এখানে কারা কারা আছেন এবং কার কার হঠাৎ করে এসে উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তখন শুরু হলো তাদের সবচে আকর্ষণীয় পরনিন্দা পর্ব ৷ তাদের কথা বার্তায় বুঝতে অসুবিধা হলো না যে যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই এদের সবারই শুধু যে পরিচিত তাই না, পারিবারিক পর্যায়েও সবার সাথেই বেশ ভালো রকমের ওঠা বসা আছে ৷ যাদের নিয়ে চর্চা হচ্ছে তাদের অপরাধগুলো মোটামুটি এই রকমের:
• এক্স সাহেব মিসিসাগাতে এতো টাকা কামাই করেছেন, এখন আরো কামাই করার জন্য ড্যানফোর্থে আরেকটা অফিস খুলেছেন; ওনার এতো টাকার কি দরকার ?
• ওয়াই ভাই ওনার হিজাবী মেয়েকে এমআইটিতে দিয়ে আসলেন নাকি জাহান্নামের দরোজায় দিয়ে আসলেন, কেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা কি এখানকার ইউনিভার্সিটিতে কিছু শিখছে না ! আর তা ছাড়া উনি হুজুর মানুষ হয়ে মেয়েকে কেন এত পড়াশুনায় উৎসাহ দিচ্ছেন ? যত্তসব লোক দেখানো ভণ্ডামি !
• জেড মিয়া তো নাকি রেমিটেন্স পাঠানোতে প্রথম কয়েকজনের মধ্যে থেকে বাংলাদেশে হেব্বি নাম কামিয়ে এয়ারপোর্টে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন ! কত কুঠি (অনেক কোটি হলে তখন সম্ভবতঃ আর কোটি থাকে না কুঠি হয়ে যায়!) টাকা যে দুই নম্বরি করে পাঠাচ্ছেন তার হিসাব তো আর সরকারের কাছে নেই !
আমি মিন মিন করে একবার বলার চেষ্টা করেছিলাম যে ভাই ওনারা যেহেতু এখানে নেই, খামাখা কেন আমরা গীবত করে পাপের ভাগি হচ্ছি ৷ এমন অদ্ভুত কথা বোধহয় কেউ আগে কখনো শুনেন নাই ৷ একজন প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, “আরে কি বলেন ভাই, কিছু বলবো না মানে, ওনারা দিনে দুপুরে ক্রাইম করতে পারবেন আর আমরা সেটার প্রতিবাদ করতে পারবো না ? ওনাদেরকে কে লাইসেন্স দিয়েছে এসব করার ?” সবার যুদ্ধংদেহী অবস্থা দেখে আমি আর কথা বাড়াতে সাহস পাই নি ৷ হোস্ট ভদ্রলোককে দেখলাম ওনার সমর্থনে প্রবল বেগে মাথা উপর নিচ করছেন ৷
অনেককেই বলতে শোনা যায় যে অমুকে দাড়ি রেখে এই কাজ করছে তো তমুকে হিজাব পরে ঢং করছে ৷ ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্য পর্দা করা আল্লাহ ফরয করেছেন ৷ এখন আমি মানি না মানি সেটা আমার ব্যাপার, সেজন্য তো আর আল্লাহর আদেশ বদলাবে না ৷ পর্দা করার মতো একটা বেসিক ব্যাপারকে অস্বাভাবিক রকমের বিরাট কোনো বিষয় মনে হতে পারে তার কাছেই যিনি আল্লাহর আদেশ মানছেন না ৷ আগেই বলেছি যে এই মানা না মানা সম্পূর্ণ আমার নিজের, আমাকে কেউ ফোর্স করছে না, ইভেন আল্লাহও না, ভুলে গেলে চলবে না যে পবিত্র কাবা শরীফে শত শত বছর যাবৎ মূর্তি রাখা এবং পূজা করা হয়েছে যা কিনা আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচে ঘৃন্য অপরাধ ৷ আল্লাহ চাইলে কি এটা বন্ধ করতে পারতেন না ? আমি পুরুষ বা মেয়ে যেই হই আমার জন্য যে পর্দার বিধান রাখা হয়েছে তা না মানলে এবং সময় থাকতে আল্লাহর কাছে মাফ না চাইলে আল্লাহর তাতে কিচ্ছু এসে যাবে না৷ ক্ষতি যা হবার তা আমারই হবে ৷
পর্দা করাটা যারা ঈমান এনেছেন তাদের জন্য খুবই বেসিক একটা রিকোয়ারমেন্ট তবে এই নিতান্ত সাধারণ বিষয়টাই অসাধারণ হয়ে যেতে পারে যদি আমাকে আমার পারিপার্শ্বিকতার সাথে এটা নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়৷ একদম প্রথম থেকে শুরু না করলে অনেক সময় এটা বেশ কঠিন হয়ে যায় ৷ আল্লাহ জানেন সেটা ৷ ইন্নামাল আমালু বিন নিয়াত; নিয়াতের উপরই আমল ৷ দ্বীনের পথে আসার জন্য যে নিজের সাথে, পারিপার্শ্বিকতার সাথে, প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে, সেটাই মুখ্য ৷ আল্লাহ সেই যুদ্ধের ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ৷ আমরা সেটা না দেখে কারুর পর্দা শুরু করা কিংবা ছেড়ে দেয়া নিয়ে নিষ্ঠুর মন্তব্য করে কি আনন্দই না পাই !
একটা ছোট উদাহরণ দেই, মেয়েদের দিকে বেসরমের মতো ড্যাব ড্যাব করে বা অশালীন ভাবে তাকানো যদি নিষেধ হয়ে থাকে তবে তা আলখাল্লা পড়া এবং দাড়িওয়ালা লোকটার জন্য যেমন নিষেধ তেমনি নিষেধ ক্লিন শেভড, হাফ প্যান্ট পড়া অথবা খালি গায়ের লোকটার জন্যও ৷ অনুরূপভাবে যা, কোনো পর্দানশীন মেয়ের জন্য নিষিদ্ধ তা যে পর্দা করেনা কিংবা এখনো পর্দা শুরু করেনি তার জন্যও সমান ভাবে নিষিদ্ধ ৷ অর্থাৎ আমি পর্দা করি না বলে আমাকে সব ধরণের শয়তানির বৈধতা দিয়ে দেয়া হয়েছে, এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই ৷
ইদানিং বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় গীবত গাওয়া বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ৷ পর্দা বা ধর্ম পালনকারীদের নিয়ে লোকের কিছু মন্তব্যে বোঝা যায় যে আমাদের মূল সমস্যা হলো যে লোকটি (লোক বলতে পুরুষ এবং মেয়ে উভয়কেই বোঝাচ্ছি) পর্দা করেও “নিষিদ্ধ কাজ” করছে তাদেরকে নিয়ে ৷ মন্তব্যকারীরা হয়তো ভাবছেন এটা করা তাদের বিরাট নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ৷ তারা হয়তো এটাকেই তাদের মতো করে ধর্ম পালনের কঠিন এবং ন্যায্য ব্রত হিসাবে দেখছেন ৷ আসল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যারা অন্যের এই সব ব্যাপারে নিতান্ত আহাম্মকের মতো আমাদের মনগড়া মন্তব্য ছুড়ে দেই, তারা হিংসুক ছাড়া আর কিছুই না ৷ আমরা “নিষিদ্ধ কাজ” গুলিকে নিষিদ্ধ বলে চিহ্নিত করতে পারছি কিন্তু একই সাথে ধরে নিচ্ছি যে ওগুলো শুধু যাদেরকে আমরা পর্দা করতে দেখি বা কোনো ভাবে ধার্মিক ভাবে চিনি, তাদের জন্যই নিষিদ্ধ ৷ যারা এই ধরণের গীবত নামক “নৈতিক দায়িত্ব” পালনের মহান ব্রতে নিয়োজিত তাদের মতো লুজার আর কেউ নাই ৷ ব্যাপারটা আমরা যদি একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে ৷ যারা জেনে শুনে বা না জেনে “নিষিদ্ধ কাজ” করছেন তাদেরকে যদি ধর্মের দিকে ঝুঁকতে দেখা যায় তখন পূর্বে উল্লিখিত “নৈতিক দায়িত্ব” পালনকারীগণ শংকিত হয়ে যান যে তাদের শয়তানি দল থেকে বোধহয় একজন বেরিয়ে গেলো, as if দলে ভারী থাকলে শাস্তিও ভাগাভাগি করে নেয়া যাবে বা আন্দোলন করে সেটাকে কমানো বা থামানো যাবে ৷
এইসব বাদ দিয়ে, কে কিভাবে ধর্ম পালন করলো সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, নিজে কি করছি কেন দেখি না ? জন্ম সূত্রে যদি ধর্ম পেয়ে থাকি, সেটাকে ধারণ করি আর হেদায়েত চাই ৷ আল্লাহ যদি হেদায়েত দেন তাহলে আমি অন্যকে কেন, নিজেকেও আল্লাহর পথ থেকে সরাতে পারব না ৷ আর আল্লাহ যদি না চান তাহলে কি হতে পারে তা তো আমরা আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রিয় চাচার ক্ষেত্রেই জেনেছি ৷
সানিয়া মির্জা মুসলমানের মেয়ে হয়ে হাফ প্যান্ট পরে টেনিস খেলছে বলে আমার মনে হচ্ছে মুসলমানের জাত গেলো ৷ আহারে, হাফ প্যান্ট পড়ার জন্য যদি তাকে জবাব দিহি করতে হয় তা সে করবে কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হিসাব কিন্তু সে ঠিকই মিলাচ্ছে ৷ আমার এত দরদ থাকলে আমি কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সানিয়া মির্জার হেদায়েতের জন্য দোয়া করিনা – ঐটাই আমার দায়িত্ব, তাকে নিয়ে গীবত করা নয় ৷ যে গীবত করলো, সে যেন তার মৃত ভাইয়ের গোস্ত ভক্ষণ করলো ৷ আর একান্তই যদি বেশি মাথা খারাপ অবস্থা হয়, পবিত্র কুরআনের লাকুমদি লুকুম ওয়ালিয়ালীদিন আয়াতটা স্মরণ করি ৷
‘তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে, তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করে থাকো’। [সূরা হুজুরাত– ১২]