বাংলাদেশি নরসুন্দরের অভাব প্রবাসজীবনে আমি প্রায়ই অনুভব করি। এই অভাব প্রথমবারের মত উপলব্ধি করি লাইবেরিয়ায় গিয়ে।পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র দেশ লাইবেরিয়া। কর্মসুবাদে যখন স্বপরিবারে আমি লাইবেরিয়া অবস্থান করছি তখন চুল কাটার প্রয়োজনে সেলুনের খোঁজে বের হই। সেসময়ে রাজধানী মনরোভিয়ার অনেক কিছুই আমি চিনি না।নতুন এসেছি, চিনব কি করে?সেলুন খোঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। বাসার কাছাকাছি দু’টি সেলুন পেয়ে গেলাম। তার মধ্যে একটি পছন্দ হলো। নাপিতকে গিয়ে আমার চুল কাটতে পারবে কি না জিজ্ঞাসা করলাম। বলাবাহুল্য, আফ্রিকানদের কোঁকাড়ানো চুল কেটে সেখানকার নাপিতরা অভ্যস্ত। সেলুনে আফ্রিকান স্টাইলে চুল কাটা মডেলদের ছবি টানানো। নাপিত ছবিগুলো দেখিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলো আমি কোন স্টাইলে চুল কাটাব।আমি তাকে আমরা বাংলাদেশিরা সচরাচর যেভাবে চুল কাটি সেই স্টাইলে চুল কাটানোর আগ্রহ ব্যক্ত করলাম। সে এমন একটা ভাব করলো যে আমার চুল কিভাবে কাটতে হবে সে বুঝতে পেরেছে এবং এ ব্যপারে সে খুবই ‘কনফিডেন্ট’। তারপর সে আমাকে বলল, ভালো হয় যদি তুমি তোমার কিছু পুরোনো ছবি নিয়ে আস যা দেখে আমি তোমার চুল ছাঁটার স্টাইল বুঝতে পারি। প্রথম থেকেই আমি তার উপর আস্থা পাচ্ছিলাম না, সেই অনাস্থার পাল্লা আরো ভারী হলো। কিন্তু কি আর করব? মাথার চুলতো অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।চুল কাটানো অতি জরুরী।তাকে বললাম, আমি আগামীকাল আমার ছবি নিয়ে আসব।
বাসায় এসে ৫-৬ টি ছবি খোঁজে বের করলাম। পরের দিন আবার গেলাম সেই নাপিতের কাছে।ছবি দেখে, ‘তোমার স্টাইলে চুল কাটা কোন ব্যাপার না’ এমন একটা ভাব নিয়ে আমাকে চেয়ারে বসতে বলল। মাথার উপর ট্রিমার চালালো ইচ্ছে মতো। কাঁচির কোন ব্যবহার সে জানে না।আফ্রিকানদের চুল কাঁচি দিয়ে কাটা মনে হয় সম্ভব নয়।তাই সে বিদ্যা তাঁর শেখার প্রয়োজন পরেনি।খুউব মনোযোগ সহকারে আমি তার ট্রিমার চালানো দেখলাম।আস্তে আস্তে আমার চেহারার পরিবর্তন স্পষ্ট হতে শুরু করলো। তাঁর চুল কাটা যখন শেষ হলো, তখন আয়নায় নিজেকে অন্যরূপে আবিষ্কার করলাম।দশ ডলার পকেট থেকে বের করে নাপিতকে দিলাম।উল্লেখ্য, লাইবেরিয়ার নিজস্ব মুদ্রা লাইবিরিয়ান ডলারের চেয়ে সেখানকার মানুষ ইউএস ডলার বেশি পছন্দ করে। সেখানে এই দুই মুদ্রারই সমান প্রচলন রয়েছে।লাইবেরিয়ান ডলার হিসাব করলে তাকে দিতে হতো ৮২০ ডলার। আমি তাকে দিলাম ইউএস ডলার।তাতে সে খুশি হলো।কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না।বাসার দিকে রওনা হলাম।আমি নিশ্চিত বাসায় গেলে, আমার স্ত্রী ও কণ্যার মুখে হাসি ও কষ্ট দু’টোই দেখতে পাব।
বাসায় আসার পর, আমার এই করুন পরিণতি দেখে আমার স্ত্রী চুল কাটার কাঁচি হাতে নিলেন। আমার মেয়েও তার মাকে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত। তাদের দু’জনের ভাষ্য চুলের এই স্টাইল নিয়ে অফিসে যেতে পারবো না। আমার স্ত্রীর মন্তব্য, এখানকার নাপিতের এই অবস্থা জানলে তোমাকে নাপিতের কাছে যেতে দিতাম না। আমিও তার কথায় সায় দিলাম। সে যাত্রায় স্ত্রীর হাতের ছোঁয়ায় আমার চুলের স্টাইল কিছুটা পুনোরুদ্ধার হয়েছিল। যে কয়েকমাস লাইবেরিয়া ছিলাম সেলুনের দিকে আর পা বাড়াইনি।
লাইবেরিয়া থেকে কানাডা আসার পর, বাংলাদেশি কোন নাপিত কাজ করেন কি না খোঁজ নিতে শুরু করলাম।একজনের খোঁজ পেলাম এবং তিনি শুধু রবিবারে কাজ করেন।কেন শুধু একদিন কাজ করেন? জানতে পারলাম, তিনি এখনও প্রয়োজনীয় কোর্স সম্পন্ন করেননি এবং সে কারণে লাইসেন্সও পাননি।কানাডার জাতীয় পেশা শ্রেণীকরণ তালিকায় নরসুন্দর পেশা (এনওসি ৬২৭১) একটি রেগুলেটরি ট্রেড অর্থাৎ এ কাজ করতে অবশ্যই লাইসেন্স নিতে হবে।বাংলাদেশি সেই নাপিতের কাছে সবসময় যাওয়া হয় না। অনেক সময় অন্যান্য সেলুনে যেতে হয়, যেখানে শুধু ট্রিমার দিয়ে চুল কাটা হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশি সেই নাপিতই হাতে কাঁচি ধরে চুল কাটেন, সারাজীবন যে স্টাইলে চুল কাটিয়েছে তিনি সেভাবে চুল কেটে দেন।আর বাকী সবারটাই কেমন যেন হয়। ভালো লাগে না। মেশিনে কাটানো মনে হয়।যত্ন করে বাংলাদেশি নরসুন্দরদের মতো চুল কাটতে জানেন না তাঁরা।চুল কাটানোর পর মাথায় পানি ছিটিয়ে বাংলাদেশে নাপিতরা যে মাসাজ করে দিত তার যে সুখ তাতো এখন শুধুই অতীত।প্রবাস জীবনে বাংলাদেশি অনেক কিছুর অভাবের সাথে নরসুন্দরদের অভাব এই তালিকাকে দীর্ঘ করেছে।
টরন্টো, কানাডা
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬