ডিসেম্বর মাস ৷ সারা বিশ্বের অন্যান্য শহরের মতো টরন্টোতেও ক্রিস্টমাসের জমজমাট আয়োজন ৷ বিভিন্ন বাড়িতে আলোকসজ্জা, অফিসে ক্রিস্টমাস অথবা বছর শেষের পার্টি, বিপনী বিতান গুলোতে কেনাকাটার জন্য উপচে পড়া ভিড়, বিভিন্ন জিনিসের দামের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়, বাৎসরিক ছুটি শেষ করার সুযোগ – সব মিলিয়ে উৎসব মুখর এক পরিবেশ ৷ হাড় কাঁপানো শীত এবং পেজা তুলোর মতো তুষারপাত কোনো কিছুই এই আমেজকে ম্লান করতে পারে না ৷ বলা বাহুল্য, উৎসবের এই আমেজ বাচ্চাদেরকেও ছুঁয়ে যায় ৷ আমাদের ছেলে রাইফকে নিয়ে একটি শপিং মলে এসেছি তার ক্লাস টিচারকে ক্রিস্টমাস উপলক্ষে দু সপ্তাহের জন্য স্কুল বন্ধ হওয়ার আগে একটি উপহার কিনে দেবার জন্য ৷ আলহামদুলিল্লাহ, লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো হলেও তার মাথায় সারাক্ষন গিজ গিজ করে বিভিন্ন রকমের গেম খেলার চিন্তা ৷ নাস্তার টেবিলে অথবা রাতের খাবারের সময় নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হলেও রাইফের আলাপ ঘুরে ফিরে মাইনক্র্যাফট বা ফরজা হরাইজন – ৩ এ এসে ঠেকে ৷ আমাদেরকে বুঝানোর ব্যাকুল একটা চেষ্টা থাকে যে নির্দিষ্ট ওই গেমটি কেনা এবং খেলা কেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ৷ শিক্ষকের জন্য উপহার কেনার পর একই চেষ্টার পুনরাবৃত্তি ঘটলো ৷ এবার কিনতে হবে “লেগো ডাইমেনশন” ৷ অল্পে সন্তুষ্টি এবং যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকার শিক্ষা নিজের ছেলে মেয়েকে দেবার চেষ্টা সব সময়ই করে থাকি ৷ কি নেই সেই চিন্তা না করে ভাবতে বলি, তাদের কি আছে যা অন্যদের নেই ৷ সব সময় যে পারি তা নয়, মাঝে মধ্যে আবেগের কাছে যুক্তি, বিশ্বাস এবং সামর্থ্য সবই হার মানে ৷ আমার দ্বিধান্বিত ভাব দেখে ছেলের অভিব্যক্তি, “Here we go, now you will say count your blessings, …..” ৷ আট বছরের ছেলেকে কি করে বুঝাই যে পাওয়ার আনন্দ থেকে না পাওয়ার অতৃপ্তিই হয়তো একদিন তার জীবনে বাস্তবতাকে বুঝা এবং জীবনের অনেক বড় অর্জনে বেশি ভূমিকা রাখবে ৷
রাইফকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে শেরবোর্ন এবং কার্লটন স্ট্রিটের মোড়ে আসতেই দেখি একটি চার্চের সামনে অনেক মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে ৷ গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই লাইনকে বলা যায় চার্চের ব্লেসিংস কাউন্টিং এর লাইন ৷ লাইনে দাঁড়ানো গৃহহীন, অসুস্থ, নিঃস্ব মানুষদের জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকেই চার্চ থেকে দুপুরের গরম খাবার বিনামূল্যে পরিবেশন করা হয় ৷ ফিরিয়ে দেয়া হয়না কাউকেই ৷ শুধু খাবারই না, সহায় সম্বলহীন মানুষদের জন্য সময়ে সময়ে শীত প্রতিরোধে গরম কাপড়, ভারী বুট এমনকি বিনা পয়সায় চুল কাটার ব্যবস্থা ও চার্চ থেকে করা হয় ৷ অবাক হয়ে ভাবি সৃষ্টির সেবার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার করুনা লাভের বিশেষ এই কাজটি আমরা করতে পারিনা কেন? আমরা দুই কিলোমিটারের মধ্যে চারটি মসজিদ তৈরী করতে পারি, কিন্তু মসজিদ থেকে অভুক্ত মানুষদের জন্য একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলে টাকা পয়সার অভাবের অজুহাত তুলি ৷ জানি না এটি কি আসলেই অর্থের অভাব নাকি আমাদের নিজেদের চেষ্টার বা চিন্তার দৈনতা ? অথচ পবিত্র কোরান এবং হাদিসে অসংখ্যবার দরিদ্র, এতিমদের খাওয়ানো এবং দানের বিষয়টি বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ৷
জীবনের একটি বড় অংশ আমরা ব্যয় করি লক্ষ্য অর্জনের দৌড়ে ৷ ভুলে যাই যে অনেক ছোট ছোট প্রাপ্তির মধ্যেই সত্যিকারের সুখ নিহিত ৷ প্রতিমুহূর্তে আমরা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেই, সুস্থ শরীর, মন নিয়ে বেঁচে থাকি পৃথিবীর আলো বাতাসের মধ্যে, ‘না চাইতেই পাওয়া’র মতো ভোগ করি আল্লাহ্পাকের অফুরান নেয়ামত ৷ কোনোদিন ভেবেও দেখিনা যে নিজের অজান্তে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা এই জিনিসগুলোই আসলে অনেক বড় “ব্লেসিংস” ৷ এই “ব্লেসিংস” পরিমাপ করার যন্ত্র এবং সামর্থ্য কোনোটাই আমাদের নেই ৷