প্রায় বিশ বছর হয় দেশ ছেড়ে প্রবাসী । প্রথম এখানে আসার পর সব কিছুই অসামাঞ্জস্য লাগত , মানিয়ে নিতে পারতাম না । কারো বাসায় দাওয়াতে গেলেও কষ্ট হতো ,রান্না বারা আপ্যায়ন এত কিছু একটা মানুষ কিভাবে এতো কাজ সামাল দিতে পারেন ! একজন নারী প্রবাসে এসে কি ভাবে জীবন যাপন করেন বাংলাদেশে থাকা একজন নারীর সঙ্গে তার যে ব্যাপক তফাত তা বুঝতে পারবেন । কন্যা জায়া জননী প্রতিটি রুপেই তার সদর্পে পদচারনা সর্বক্ষেত্রে ।
এই বিদেশ বিভুয়ে । আমি শুধু গ্রেটার টরোন্টোর নারীদের দেখেই ধারনা করতে পারি সারা দুনিয়ার যে কোন দেশ, হোক সে ইংল্যান্ড , অস্ট্রেলিয়া , বা নিউইয়র্ক এই প্রবাসে কেম ন আছে জয়ীতারা ।
যে মেয়েটি দেশে শাড়ি, গহনা আর স্বামীর বাহারী চাকুরী বা ব্যবসার গল্পে নিজেকে গরবিনী ভাবত আর এক গ্লাস পানিও ঢেলে খায় নি বলে যে খুব গর্বিত হতো , সেই মেয়েটিও নিজেকে মনের আয়নায় আবিস্কার করে নেয় তার মানুষ স্বত্ত্বাটিকে । স্বামীর প্রতিটি কথা যে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতো হোক সে ন্যায় বা অন্যায় , সে এখন আর ছেড়ে কথা বলে না বা নির্বাক থাকে না । প্রতিটি ক্ষেত্রে সে আমার আমিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠে । বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে সুখের সীমা রেখা টানা যায় না মেয়েটি বুঝতে শিখে ।
একজন নারী সে ঘরের প্রতিটি কাজ করে , বাইরে চাকুরী , বাচ্চার দেখাশোনা ,হোম ওয়ার্ক এ হেল্প ,স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং এ তার গুরুত্বপূর্ন মতামত ব্যক্ত করেন । অথচ এই মেয়েটি একদিন সদর ঘাট , আরিচা বা ঢাকা শহর সব জায়গায় স্বামীর হাত ধরে চলেই অভ্যস্ত ছিল । কোন সিদ্ধান্ত নিতে হাজার বার কারো মুখপানে তাকাতে হতো ।
মেয়েটির সকাল শুরু হয় সন্তান কে স্কুলে পাঠানোর মধ্য দিয়ে , আর সাথে যদি ছোট আর দুই একজন বাচ্চা থাকে , কি বরফ , বৃষ্টি বা প্রচন্ড রোদ এই বাচ্চাগুলোর স্ট্রলার ঠেলেই এই কাজ সে সামাল দেয় । সব চেয়ে কঠিন সময় পার করে যখন সে মা হয় । হাস্পতালে শিশুটির জন্মের কয়েক ঘণ্টা পরেই মায়ের পাশের বেডে দেয়া হয়, এই যে শুরু আবার বাসায় একা একাই সেই বাচ্চা টিকে একহাতে সামাল দিতে হয় । নিজের ঘুম, খাওয়া প্রায় মেয়েটা ভুলেই যায় । এক্ষেত্র এখন কার এই প্রজন্মের ছেলেদের প্রশংসা না করে পারা যায় না , তারাও চেষ্টা করেন স্ত্রীকে সাহায্য করতে । অথচ দেশে থাকলে তার আশে পাশে থাকতো কত প্রিয় জনেরা ।
যে মেয়েটি স্বামীর পাশের সীটে বসে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকত এতো লেনের হাইওয়েতে গাড়ী চালানো দেখে, আর স্বামী বেচারাও মনে মনে ভাব নিত দেখো দিল্লী কত দূর ! সেই ভীতু মেয়েটিও একদিন সেই ১৬ লেনের ৪০১ এ গাড়ি নিয়ে ইস্ট বা ওয়েস্ট এ শত শত মাইল ড্রাইভ করছে একশো বিশে । এই মেয়ে আবার ছুটির দিনে সাজ গোজ করে বাইরে বেড়াতে যায় , গান, আবৃত্তি , সাহিত্য চর্চা প্রচন্ড শীতে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেয়া , নব বর্ষের সাজে, কোথায় নেই এই মেয়ে । সে নিজের ব্যবসা চালায় , পঞ্চাশ জন মেহমানের রান্না একাই করে । বাজার ক রা থেকে শুরু করে গার্বেজ ফেলানো সবই সে করে এখানে একমাত্র ভরসা তার স্বামী যদি সে সহযোগী হয় । আর এই পুরুষ সহযোগী হন কিন্তু বেশীর ভাগ সিদ্ধান্ত নেন এই নারী । আবার সে নিজেই শেখায় তার সন্তান কে ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করতে আত্মনির্ভরশীল হতে ।
বাড়িতে এক চিলতে জায়গা আছে , সেখানে একটি সব্জী বাগান, বা টবে ফুলের গাছ্ সন্তান ধারন , পালন , অসুখে নির্ঘুম রাত যাপন ,দেশে প্রিয়জন্ দের সুখ দুঃখের সাথী আবার এই মেয়ে প্রিয়জন হারানোর ব্যাথায় একাকী কাঁদে । খুব একাকী যখন তখন সে আবার সৃত্মি খুঁজে বেড়ায় ফিরে যেতে চায় তার প্রিয় আজ্ঞিনায় , দূরে কোথাও দূরে দূরে , যেখানে রয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া মা আর প্রিয় মাতৃভূমি ।