খ্রিস্টানদের দেশে বসবাস করছি প্রায় দুই যুগ ধরে। এই দুই যুগে শ্বেতাঙ্গ জাতির লোকজন নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বেশ কিছু নতুন নতুন পজেটিভ, নেগেটিভ অভিজ্ঞতা নিত্যদিন জমা হচ্ছে যা আমি আমার গল্প উপন্যাসে ইনিয়ে বিনিয়ে রেখে ঢেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সাদা জাতি বলতে আমি কানাডায় বসবাসরত Caucasian race এর সাদা চামড়ার লোকজনদের বুঝিয়েছি। আজ থেকে আরও দুদিন পরে খ্রিস্টানদের ক্রিস্টমাস। গতকাল থেকে টরেন্টোতে স্নো পড়া শুরু হয়েছে। সাদারা বেশ উল্লসিত, এবার এখানে হোয়াইট ক্রিস্টমাস পালিত হতে যাচ্ছে। তাই ভাবলাম এই সাদা চামড়ার জাতির নিয়ে সামান্য কিছু বলার চেষ্টা করি।

আমরা যেমন কারো সাথে অল্পস্বল্প পরিচয়ে হড়হড় করে মনের কথা, নিজের কথা বলে ফেলি, সাধারণত সাদারা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা করেন না। এঁদের ভাষায় ‘বাউন্ডারি’ মেইনটেইন করাকে এঁরা বেশ গুরুত্ব দেয়। যার কারণে এঁদের মাঝে দেখা যায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক, কাজের যায়গায় কলিগের সাথে সম্পর্ক অনেকদিন টিকে রেখেছে। অবশ্য, পারিবারিক সম্পর্কের ব্যাপারটি আলাদা। এক্ষেত্রে, আমরা ওদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে আছি।

দুদিন আগেও, কাজের যায়গায় আমার রাশভারী লাজুক বসের পারিবারিক ব্যাপারগুলো জানতাম না। গতকাল টিমের সাথে ক্রিস্টমাস উপলক্ষ্যে বাইরে লাঞ্চ করতে যেয়ে বস সম্পর্কে অনেক নতুন কিছু জেনে অভিভূত হলাম। ভদ্রলোকের বাবা ওনাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তখন ওনার অর্থাৎ আমার বসের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। সেই বয়স থেকেই উনি দেখেছেন তার মা একের পর এক বয়-ফ্রেন্ড বদল করছেন আর ভিন্ন ভিন্ন পুরুষকে তাঁকে বাবা ডাকতে হচ্ছে। নিজের ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যাবসায়ের গুনে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়ে মেন্টাল হেলথ সেক্টরে ক্যারিয়ার শুরু করে এক পর্যায়ে আমাদের বস হয়েছেন। আমাদের অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ানদের মধ্যে মধ্যে এই ধরণের ব্যাপার এভাবে না ঘটলেও সৎমায়ের/ সৎবাবার শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মাঝেও কিছু কিছু মানুষের সাফল্যের অল্পবিস্তর উদাহরণ দেখেছি। আসলে, মোদ্দা কথা হচ্ছে নিজের ইচ্ছাশক্তি (self -determination ) আর অধ্যাবসায়ই হচ্ছে সফলতার চাবিকাঠি। এই শাশ্বত বাণী, এবারের ক্রিস্টমাস সিজনে বস আমাকে নতুন করে উপলদ্ধি করা সুযোগ করে দিলেন।

এবার আসি লাইফ স্কিলস প্রসঙ্গে। অফিসে ক্রিস্টমাস ঘিরে ধুমধাম শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবছর ক্রিস্টমাস কেন্দ্র করে আমাদের অফিস থেকে ক্লায়েন্টদের রকমারি গিফট দেয়া হয়। আজ অফিসে ক্রিস্টমাস ডেকোরেশনের টিমে সাদাদের সাথে কাজ করতে যেয়ে ওদের বিপরীতে নিজের লাইফ স্কিলসের ব্যাপারটি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সাদাদের সাথে কাজ করতে যেয়ে দেখেছি এঁদের লাইফ স্কিলস বেশ শাণিত। পুঁথিগত জ্ঞানের বাইরে বিশাল যে জগৎ রয়েছে, সে জগতে বিচরণ করে নিজের লাইফ স্কিল্সকে সমৃদ্ধ করে তর তর করে যেমন এঁরা এগিয়ে যায়, তেমনি কত অনায়াসে এঁরা চারিপাশের মানুষদের মনজয় করে হাসি ফুটিয়ে রাখে।

দশ-ভাইবোনের পরিবারে সর্বকণিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সবার পরম শ্নেহ মমতায় বেড়ে উঠে পরিবারের পাঠশালায় আমার লাইফ স্কিলস তেমন একটা শাণিত হতে পারেনি। আমাকে আজ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ক্লায়েন্টদের জন্য গিফট প্যাকেটগুলোকে রঙিন কাগজ দিয়ে ভালোভাবে Wrapping করা। আমার এই জীবনে কখনো এই কাজ করিনি। গিফট কিনে হয়তো দোকানেই Wrapping করেছি নয়তো বাসায় বাচ্চারা করে দিয়েছে। দুরুদুরু বুকে কাগজ কেটে দোয়া ইউনুস পড়ছি। পরীক্ষার হলে পাশের সীটের সহপাঠীর খাতা দেখে যেভাবে চুপি চুপি দুষ্ট ছেলেরা যেমন নকল করে আমি সেভাবে পাশের কলিগদের দিকে তাকিয়ে অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। দুই পাশের কাগজ কোনোরকমে মিলিয়ে স্কচটেপ লাগালাম, কিন্তু বাকি দুই প্রান্তের দুই পাশের কোনাগুলো কিছুতেই মিলছে না। টিউমারের মতো ফুলে আছে। আমার করুন অবস্থা দেখে আমার কলিগ যত্ন করে আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন। আমি অতি মনোযোগের সাথে নির্ধারিত বক্সগুলো Wrapping করে ব্যাগে গুছিয়ে রাখার পরে আমাদের টিম লিডার বললেন, ‘তুমি কি গিফটগুলোর প্রাইজ লিস্ট ডিলিট করেছো ?’ আমি প্রমাদ গুনলাম। আবার একটি একটি করে পরম যত্নে করা মোড়ক বাঁধানো বক্সগুলো খুলে প্রাইজ লিস্ট মুছে ফেলে আবার নতুন করে Wrapping করে আমার লাইফ স্কিলস কে সমৃদ্ধ করার কাজে মন দিলাম। এবারের ক্রিস্টমাসের কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ।

সবশেষে যেটি বলবো সেটি হচ্ছে সাদাদের সেন্স অব হিউমার। এঁরা কখন যে জোকস করে কথা বলে কখন যে সিরিয়াস কথা বলে তা নতুন ইমিগ্রান্টদের পক্ষে ধরে ফেলা কিছুটা কষ্ট সাধ্য। তবে, জোকস হোক, আর সিরিয়াস কথা হোক, এঁদের মুখ খারাপের নমুনা শুনে মাঝে মাঝে শিঁউরে উঠতে হয় । একটি বাক্য বলতে প্রায় প্রতিটি শব্দ ‘এফ’ ওয়ার্ড দিয়ে শুরু না করলে মনে হয় এঁদের বদ হজম হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে আগত কোনো নিউ ইমিগ্রান্ট এসব ভাষা শুনলে আক্কেল গুড়ুম হওয়ার কথা। যাক এসব কথা, আমি এঁদের ভাষাগত শব্দের অপপ্রয়োগে কিছুটা অভ্যাস্ত হলেও এঁদের জোকস এর ব্যাপারে এখনো তেমন অভিযোজিত হতে পারেনি। এখন, সেটি নিয়েই বলছি।

সকালে অফিসে যেয়ে চমকে গেলাম। আমাদের টিমের একজন আমাদের রুমের তিনজনের জন্যে ক্রিস্টমাস গিফট উপহার দিলেন। আমরা সহাস্য মুখে গিফট নিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। খাওয়াদাওয়ার জগতে যেমন নিয়ম হচ্ছে দাওয়াত খেলে দাওয়াত দিতে হয়, তেমনি গিফটের জগতেও নিয়ম হচ্ছে গিফট পেলে গিফট দিতে হয়। আমাদের একজন লাঞ্চটাইমে আমাকে সাথে নিয়ে বাইরে যেয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করে দুজন কলিগের জন্য গিফট পছন্দ করলেন। আমার কলিগ বললেন তুমি দাম দিয়ে দাও আমি ইট্রান্সফার করবো। আমি এবং মিতা ইতোপূর্বে এই জাতীয় কেসে বেশ ধরা খেয়েছি। তবুও নিমরাজী হয়ে আমার ক্রিডিট কার্ডে পে করতে হলো।

ইট্রান্সফারের জন্য ইমেইল এড্রেস জানতে হয়। আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম, সেই কলিগ ভদ্র মহিলা আমার একই রুমে বসে এটা-ওটা কাজ করছেন কিন্তু ইমেইল এড্রেস জানা কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছেন না। সাদা জাতির মধ্যেও যে আজান দিয়ে চড়ে খাওয়ার ব্যাপার আছে তা আমি কমবেশি জানতাম। যাক, কি আর করা। পুরো দিন অফিসে একই রুমে কাটালাম কিন্তু ওনার মুখে ইট্রান্সফারের নামগন্ধ একেবারেই পেলাম না। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আমার ডেক্স ওনার পাশেই। ওনার পাশে বসে মুখে না বলে আমি  সাহস করে আমার পার্সোনাল ইমেইল নাম্বার ওনাকে টেক্সট করে দিলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে থ্যাঙ্কস দিলেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। পাঁচটা বেজে গেছে। গাড়িতে স্টার্ট দিতেই টুক করে মেসেজ আসার শব্দ পেলাম। সেই কলিগের টেক্সট দেখে দ্রুত মেসেজটা পড়লাম। উনি লিখেছেন ‘ money no sent, debt . Haha। বদমাইশ মহিলা, টাকা নাই তো অত দামি গিফট কেনার কি দরকার ছিল!! ডলার স্টোর থেকে সস্তা কিছুমিছু কিনলেই ল্যাঠা চুকে যেত। তারপরে আবার বেহায়ার মতো লিখেছে ‘হাহা’। সারা রাস্তা সেই মহিলাকে নিয়ে এসব উথালপাতাল ভাবলাম। বাসায় এসে ছেলের সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাংলাদেশের টি টুয়েন্টির ধবল ধোলাইয়ের সেই বিখ্যাত খেলা দেখতে বসেছি। খেলার ফাঁকে ইমেইল চেক করতেই দেখি সেই মহিলা আমাকে ইট্রান্সফার করেছে। সময় মিলিয়ে দেখলাম, আমাকে বোকা বানিয়ে আমার সাথে মজা করে উনি ইট্রান্সফার করে তারপরে আমাকে সেই টেক্সট করেছিলেন। এই হচ্ছে সাদা জাতি। এঁরা ফান করে, তবে কথা রাখে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : আজ থেকে অনেক অনেক বছর পরে প্রবাসে একটি অফিসে এক বাংলাদেশী তরুনের প্রচন্ড কর্মদক্ষতায় অভিভূত হয়ে এক Caucasian race এর সাদা চামড়ার ভদ্রমহিলা কলিগ অভিভূত হয়ে বাংলাদেশ সম্পর্ক্যে আরও জানার জন্যে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে যেসব তথ্য পেলেন তাতে তিনি ইমোশোন্যাল হয়ে দ্রুত পুরো ইতিহাস পড়তে থাকলেন। ৫২’তে ভাষার জন্যে রক্ত দানের ঘটনা, মানচিত্রের জন্য ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ এর ছাত্রজনতার কালজয়ী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে পাওয়া ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর মর্মান্তিক ইতিহাস পড়ে বাংলাদেশিদের নিয়ে রাজ্যের মুগ্ধতা ছড়িয়ে ফেসবুকে তিনিএকটি পোষ্ট লিখলেন: ‘এক সাহসী বাংলাদেশী জাতির উপকথা’।

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালচাল : কানাডার জীবন কঠিন তবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
পরবর্তী নিবন্ধহালচাল : নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন