২০০৮ সাল। কাজ করি তখন অন্টারিওর মিনিস্ট্রি অফ হেলথ প্রমোশনে। আমার সাথে একই টিমে কাজ করেন ময়ূর নামের এক ভারতীয় সহকর্মী। বই পড়ায় তার আগ্রহ অকল্পনীয়। প্রতি সপ্তাহে তার ব্যাগ থেকে বের হয় Patanjoli বা The God of Small Things এর মতো ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের বই। অফিসে লাঞ্চ ব্রেকের টাইমে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবার শেষ করে ময়ূরের আগ্রহের কারণে দুজনেই হাটতে হাটতে চলে যাই অফিসের কাছাকাছি ২০ এডওয়ার্ড স্ট্রিটে অবস্থিত এক বইয়ের দোকানে। নামটি ছিল অনেকটা অপ্রচলিত -“World’s Biggest Book Store”। ৬৪০০০ বর্গফুট আয়তনের এই বইয়ের দোকানটি আসলেই “World’s Biggest Book Store” ছিল কিনা জানি না, তবে তিনটি ফ্লোর নিয়ে সাজানো এই গ্রন্থাগারে প্রবেশ করলে হাজারো বিষয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা দেখে বিস্মিত না হওয়ার উপায় ছিল না । আমাদের মতো অসংখ্য সাধারণ পাঠককে বিস্মিত করে ২০১৪ সালে টরোন্টোর ‘Iconic’ এই বুক স্টোরটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। যাহোক এই গ্রন্থাগারেই ময়ূরের কল্যানে পরিচয় হয় ‘Who Will Cry When You Die’ নামে আত্মউন্নয়ন গুরু রবিন শর্মার এক বইয়ের সাথে। রবিন শর্মার সূত্র ধরে ‘Secret’ খ্যাত Rhonda Byrne, Vincent Peale , Eckhart Tolle, Tony Robbins, Deepak Chopra সহ অনেক আত্মউন্নয়ন বিষয়ক পন্ডিতদের বই পড়ার সুযোগ হয়েছে। মন, বিশ্বাস এবং আত্মউপলব্ধী নিয়েই তাদের সমস্ত আলোচনা কেন্দ্রীভূত। ঘুরে ফিরে প্রায় সবারই মূলমন্ত্র হচ্ছে “ভাবনার জগৎকে পরিবর্তন করো, তোমার নিজের ভুবন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরিবর্তিত হবে” । অনেকটা মহাত্মা গান্ধীর বাণী, “Change your thoughts, change your world” এর মতোই। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে সাম্প্রতিক কালে নুতন মোড়কে, যুগোপযুগী, আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হলেও মন ও মনের চালককে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে হাজার বছর আগে।
মহাত্মা গৌতম বুদ্ধ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মানব মনকে তুলনা করেছিলেন “Kapicitta” বা বানর মনের (Monkey Mind) সাথে। বানরের মতো গাছের এক শাখা থেকে আরেক শাখায় লাফিয়ে বেড়ানো মনকে বশীভূত করার উপায়ও বাতলে দিয়েছিলেন তিনি। হিন্দু মনোবিজ্ঞানে মানব মনের Subconscious, Conscious এবং Superconscious নামে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে superconscious বা অতিসচেতনতার স্তরে এসে মানব মন যে অবস্থায় উপনীত হয় তা হচ্ছে “সমাধি’। এই স্তরে পৌঁছুতে পারলে মানুষ দিব্যজ্ঞান লাভ করে, জগতের দেখা না দেখা অনেক কিছুই তখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠে। খ্রীষ্টধর্মের বাইবেলে বলা হয়েছে, “Keep your heart with all vigilance, for from it flow the springs of life.” ইসলামে মন এবং প্রবৃত্তিকে একত্র করে “ইলমুল নাফস” নামে একটি আলাদা concept ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলিম মনীষীরা ‘নাফস’ শব্দটিকে যথাক্রমে ‘কলব’ (হৃদয়), ‘রূহ’ (আত্মা), ‘আকল’ (বুদ্ধিমত্তা) ও ‘ইরাদা’ বা ইচ্ছাশক্তি এই চারভাগে ভাগ করে নাফ্সকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়ের কথা বলেছেন। সুফী সাধকরা স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় এর উপর অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মোটকথা সব ধর্মেই মন তথা অন্তরকে কলুষমুক্ত করে নির্মোহ জীবন যাপনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এটি নুতন কোনো বিষয় নয়।
মন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের প্রাসঙ্গিকতার সীমানা ছাড়িয়ে গ্রাম বাংলার লোকায়ত গানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেও অনেক কিছুই ধরা পড়ে। ফকির লালন তার গানে বলেছেন, ” না ঘুচিলে মনের ময়লা, সেই সত্য পথে না যায় চলা। মন পরিষ্কার করো আগে, অন্তর বাহির হবে খোলা”। কোনো কোনো গান আবার মনের চালককে উদ্দেশ্য করেই লেখা। যেমন বাউল শাহ আব্দুল করিম অভিমানী সুরে গেয়েছেন, ” আমি তোমার কলের গাড়ী, তুমি হও ড্রাইভার। তোমার ইচ্ছায় চলে গাড়ী, দোষ কেন পড়ে আমার।” কিছু গানের সুর আমাদেরকে আরো ভাবুক করে তুলে, নিয়ে যায় অন্য কোনো ভুবনে। হাওর অঞ্চলে কোন এক অলস দুপুরে মাঝি যখন উদাস সুরে গান ধরেন,
“মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না,
সারাজনম উজান বাইলাম, ভাটির নাগাল পাইলাম না।
আমি আর বাইতে পারলাম না।”
মনমাঝি তখন বৃহত্তর এক ভিন্ন সত্ত্বা নিয়ে আবির্ভুত হন আমাদের কাছে। মানবজনম, জীবনের সীমাবদ্বতা ও স্রষ্টার অন্নেষণ নুতন করে ভাবায় আমাদের। কে জানে, সুখের আশায় জীবনভর ঘাটে ঘাটে তরী ভিড়িয়ে আমরাও হয়তো নিজের অজান্তে এই মনমাঝিকেই খুঁজে বেড়াই।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে
World’s biggest book store কে মিস করি। আমি তখনো রেস্তোরায় কামলা দেই একবেলা আর এক বেলা ইস্কুলে যাই। এর মাজের সময় লাঞ্চ করে চলে যেতাম Eaton সেন্টারের চাপ্টারস বা ইন্ডিগো বইয়ের দোকানে অথবা World’s biggest book store যেতাম। ওখানে বসে নিরিবিলি ক্লাস assignment এর কাজ করতাম আর মাঝে মাঝে পছন্দের বই নিয়ে ওখানে বসেই পড়ে আসতাম কারণ তখন হাতে টাকা পয়সার টানাটানি ছিল। আর সে সময়কার খুব ভালো লাগা বইয়ের ২/১টি পরে হাতে টাকা হলে কিনে ফেলেসি।
খুব ভালো লিখেছেন ভাই। অল্প পরিসরে অনেক ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মানুষের কথা বলেছেন। এদের অনেকেই আমার জীবনের অনেক কিছু পরিবর্তনে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে রবিন শর্মার নাম না নিলেই নয়। এ নিয়ে সময় পেলে লিখবো। যেকেউ আপনার লেখায় উল্লেখিত মানুষের লেখা শুনলে বা পড়লে এবং সেগুলি যদি কর্মে খাটায় তার অনেক অনেক সমস্যার সমাধান হবে এবং সবসমই “মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না,সারাজনম উজান বাইলাম, ভাটির নাগাল পাইলাম না” বলতে হবে না।
তবে হাঁ, মাঝে মাঝে নস্টালজিক হওয়া আমার মনে হয় মনের খোরাক, এবং তখনই এই মনমাঝির দরকার হয়। ভাটির নাগাল আসলে কি পাওয়া যায়, নাকি পাওয়ার চেষ্টাটাই “Success”.
ভালো থাকবেন হাসান ভাই।
“corporate greed” যে কিভাবে মানুষের intellectual বা cultural need কে ঢেকে ফেলে, এই বইয়ের দোকানটি বন্ধ হয়ে যাওয়া তার প্রমান। সময় নিয়ে পড়া ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ মুকুল ভাই. বিশেষ করে আপনার শেষ লাইনটি। আসলেই, ভাটির দেখা সহজে মিলে না, কিন্তু সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে. ভালো থাকুন।