আসছে ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। সাত সমুদ্দুর তেরো নদী, আটলান্টিক মহাসাগর আর কালাপানি পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি কানাডা। জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে আমরা পাড়ি দিয়েছি অনেক পথ। এখানেই মানিয়ে নিয়েছি বা নিচ্ছি আমাদেরকে। কিন্তু বাংলাদেশ রয়েই গেছে আমাদের সম্পূর্ণ সত্তায় আর মননে। একমুহূর্ত ভুলে থাকতে পারি না আমাদের মাতৃভূমিকে। আমাদের মন পড়ে থাকে জন্মভূমি বাংলাদেশে। যেখানে আছে আমাদের মা–বাবা, ভাই–বোন, আত্মীয়–স্বজন আর বন্ধু বান্ধব। আরো ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা আর ভাষা শহীদ। আর তাইতো শাহনাজ রহমতুল্লার গানটি সারাক্ষন মাথায় ঘুরছে – “আমারো দেশের মাটির গন্ধে ভোরে আছে সারা মন, শ্যামল, কোমল, পরশ ছাড়া যে নেই কিছু প্রয়োজন। ‘”
দেশে যাঁরা থাকেন তাঁদের কেউ কেউ বলেন– ” এসব হলো ন্যাকামি, দুঃখ বিলাসিতা। দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়েছে আর মুখে দেশপ্রেমের মিথ্যা ফুলঝুরি ফোটায়। ” আসলে ব্যাপারটা কি সেইরকম? বিষয়টি যাঁরা পরবাসে থাকেন তাঁরাই ভালো বুঝবেন। যতই আমরা উন্নত বিশ্বের নিরাপদ শহরে উন্নত জীবন যাপন করি না কেন, দেশের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি আমাদের অন্তরে গেঁথে আছে সদা সর্বদাই। আমাদের লাল–সবুজ পতাকা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি , বাংলাদেশের মাছ, ডাল, ভাত আমাদের সাথেই আছে সদা সর্বদা। প্রবাসীদের পোড়া মন এগুলো ভুলে থাকতেই পারে না; শত চেষ্টা করলেও না।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয় যেমন আমাদেরকে আনন্দে উদ্বেলিত করে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের নির্বাচনী সহিংসতা, নিরাপত্তাহীনতা, গুম খুন, নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন সবকিছুই আমাদেরকে উদ্বিগ্ন এবং উদ্বেলিত করে–কোনো কিছুই আমরা এড়াতে পারি না, হাজার চেষ্টা করলেও না। আর এজন্যই বোধ হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কপোতাক্ষ নদ কবিতায় বলেছিলেন– “বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ – দলে কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে। ” যশোরের সাগরদাঁড়িতে তার সমাধিস্থলে তাঁরই লেখা খোদিত আছে–
” আর কি হে হবে দেখা?- যত দিন যাবে ,
এ প্রবাসে মজি প্রেম ভাবে , লইছে যে তব নাম বঙ্গের সংগীতে।
দাঁড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তবে বঙ্গে ! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে। ”
কবি মধুসুধন বহু দিন প্রবাস জীবন কাটানোর পরেও, ধর্ম ত্যাগ করার পরেও, মৃত্যুর আগে পৌঁছতে পেরেছিলেন তাঁর পৈতৃক ভিটেয়। তাঁর সমাধিও হয়েছিল সেখানেই।
বিশিষ্ট কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী লিখেছিলেন-
” হউক সে মহাজ্ঞানী, মহাধনবান,
অসীম ক্ষমতা আর অতুল সম্মান,
কিন্তু যে সাধেনি কভু জন্মভূমি হিত
অতীব ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর। ”
আমাদের সবার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাস প্রবাস জীবন যাপন করলেও ধানসিঁড়ি তীরের রূপসী বাংলাকে ভুলে থাকতে পারেন নি এক মুহূর্তের জন্যেও। আর তাই মৃত্যুর পর শঙ্খচিল শালিখের বেশে কার্তিকের নবান্নের দেশ বাংলাদেশে ফেরার আকুতি প্রকাশ করেছেন। আমরাও প্রবাসে ডিসেম্বরের বরফে ঢাকা টরেন্টো শহরে খুঁজে ফিরি বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা , গাইতে চাই– আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। সারা শহর যখন ক্রিস্টমাসের বর্ণিল সাজে সজ্জিত , খ্রীষ্টমাস ট্রি, শান্তা , চকলেট , জিঞ্জার কুকিস, কেক আর ক্রিসমাসের পোশাক এবং ক্রিসমাস ডিনার নিয়ে যখন শহর বাসি ব্যাস্ত, আমরা তখন ছুটি চাই ডানফোর্থের বাংলা পাড়া বা অন্য কোথাও বিজয় দিবস পালন করার জন্য। কনকনে ঠান্ডায় লাল–সবুজ শাড়ি পরে, বাচ্চাদের জোর করে নিয়ে আসি আমাদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে। যেখানে আমরা দেশি খাবার খাই, দেশি গান গাই আর বেশি বেশি করে মনে করি আমাদের জননী, জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী। আমরা চেষ্টা করি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস, পোশাক, খাবার সম্পর্কে জানাতে। এদেশে বসেও আমরা ডাল–ভাত, মাছ, পিঠা পুলি দেশের মতো করেই খাওয়ার চেষ্টা করি।
দেশের কোনো একজন স্বনামধন্য ব্যাক্তিত্ব একবার বলেছিলেন– আমরা যারা ইউরোপ আমেরিকা থাকি আমরা নাকি বিশিষ্ট বেঈমান, আমাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করা উচিত। কারণ আমরা দেশের টাকায় বড়ো হয়ে এসব দেশে চলে এসেছি। আমরা কখনো দেশের কোনো খোঁজখবরও রাখি না, টাকা পাঠানো তো দূরেই থাক। আমরা কেবল মাত্র দেশে যাই মা–বাবা মারা গেলে তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আনতে। আমার জানা মতে এমনটি কেও করেন বলে মনে হয় না। যদি কেও এমনটি করে থাকেন তবে সেটি নিন্দনীয় অপরাধ। যে মা–বাবা আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে এনেছেন, কত কষ্ট করে আমাদেরকে লালন পালন করেছেন, সেই মা–বাবাকে কষ্ট দেয়া বা ভুলে যাওয়া গর্হিত অপরাধ। আমি বরং আমার চারপাশে উল্টোটাই দেখি। যারা একদম নতুন আসেন তারা হয়তো শুরুতেই করতে পারেন না, একেবারে শূন্যথেকে শুরু করে উঠে দাঁড়ানো তা অত সহজ নয়। আমার চারপাশে যাঁরা আছেন তাঁরা মা–বাবা তো বটেই, ভাই বোন গরিব আত্মীয় স্বজনের অসুখ বিসুখ, বিয়ে, যে কোনো উৎসব, লেখাপড়া, সব কিছুর জন্যই টাকা পয়সা এবং উপহার সামগ্রী পাঠাতেই থাকেন। প্রতি বছর সবাই মিলে একবার করে হলেও দেশে যান। তিনি আরো বলেছিলেন– অথচ মধ্যপ্রাচ্চের প্রবাসীরা তাঁদের যাবতীয় রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়ে দেন। আমিও মধ্যপ্রাচ্চের সরকারী বিশ্ববিদ্দালয়ে শিক্ষকতা করেছি– আমি জানি ওখানে নিজের নামে বাড়ি গাড়িই কেনা যায় না আর অভিবাসন তো দূরেই থাকুক । আর সেজন্যই মদ্ধপ্রাচ্চের সবাই সব টাকা পয়সা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বেসরকারি ভাবে কফিল বা মালিকের মাদ্ধমে যারা ওখানে যায় তাদের টাকাপয়সা অনেক সময় মালিক ই নিয়ে নেয় ।
যে সন্তান পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার বা সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অন্য ভাই–বোনের সাথে গোলমাল করে, সে দেশে থাকলেও করে বিদেশে থাকলেও করে। শুধুমাত্র প্রবাসীরা দেশে পিতামাতার সম্পত্তি বিক্রি করতে যায় – কথাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা ভেবে দেখা দরকার।
যাই হোক কে কি বললো বা কে কি ভাবলো তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আসুন আমরা বরং নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি– আমরা আমাদের মা–বাবা , ভাই বোন আত্মীয় স্বজন আর জন্মভূমির জন্য কি করেছি , কি করতে পারছি বা কি করতে চাই। আমরা আমাদের কর্মা বা কর্মফলের কথা ভাবি আমাদের এই নশ্বর জীবনেই, মৃত্যুর পরের জীবন তো আছেই।
আসন্ন বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দেশে বিদেশে সকলের জন্য মঙ্গল কামনা করছি, আপনাদের সবার সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করছি, প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের সফলতার দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকলাম।
(ছবি:-সৌজন্য flicker.com)
মাহমুদা নাসরিন, শিক্ষক, সমাজকর্মী, ইমিগ্র্যাশন পরামর্শক।
টরেন্টো , কানাডা।