আমাদের বাসায় চুরি হবার পর পুলিশ কেস নিল , বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট কে ডাকলো । সব চেয়ে হাস্যকর যে ব্যাপারটা হলো পুলিশকে ম্যানেজ্যার বলছে আমি জানি এরা কারা সো আমি ওদের কিক আঊট করব যাতে এখানে আর আড্ডা দিতে না পারে । আর পুলিশ একটা নাম্বার আমার হাতে দিয়ে বললো তুমি যদি ওদের আবার দেখ তবে এই নাম্বারে ফোন দিও ।আমি বললাম এদের ধরার দায়িত্ব কি আমাদের নাকি !! তারপরে সেই গুন ধরদের অনেকবার দেখেছি ভয়ে পুলিশকে বলি নাই কারন শরীরের রক্ত তো সেই আর্যদের , কখন কি হয় ! তারপরের সপ্তাহে এই ঘটনা এক পাকিস্তানীর বাসায় ঘটালো । বুঝলাম এরা সেই দেশী স্টাইলে চলে ভালো হয় বাসা যদি মুভ ক রতে পারি । তাও পারলাম না গ্রান্টার ছাড়া তিন বাচ্চানিয়ে ২ বেড রুমে ওঠা যাবে না । একজন বুদ্ধি দিল ২ বাচ্চার নাম দেন । আমার বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল , বললাম না এই চোরদের সাথেই থাকব তবু এটা করতে পারব না ।
আমার কাজ , ভলান্টারি , বেবী সিটিং সব চলছে আর আমার হাজব্যান্ড সেনেকা কলেজে সন্ধ্যায় ক্লাশ করে প্রোগ্রামিং এর আর সারাদিন রেজুমি লিখে চাকুরী খোজে । যদিও ১৪ বছর প্রোগ্রামার ছিল মহাখালী কলেরা রিসার্চে( আই, সি, ডি, ডি, আর বি) , কিন্তু সেই সোনার হরিন ধরা দেয় না । ইতিমধ্যে আরোও ২ টা বাংগালী ফ্যামিলির খোঁজ পেলাম । একজন আমার দেশী ফরিদপুরের ( ইমাম মামার ভাগ্নী) পল্লব আর একজন নরসিংদীর শরীফ ভাই । হাফ ছেড়ে বাচলাম এতোদিনে । আমরা বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরি পার্কে, হেটে হেটে অন্টারিও সায়েন্স সেন্টার, লাইব্রেরী সব জায়গায় যাই আর ভুলতে চেষ্টা করি প্রিয়মুখগুলোর কথা ।
আমার ব্যস্ততার মাঝে আরেকটা দায়িত্ব নেই গ্রীনোবল পাব্লিক স্কুলে বাংলা স্কুল খোলার । আমি , রেহানা আপা ( ইঞ্জিনিয়ার নাসির ভাই এর স্ত্রী) আশে পাশের ফ্লাটে থাকা বাংগালীদের বোঝাতে চেষ্টা করি ২৫ জন ছাত্র/ছাত্রী হলে বোর্ড পার্মিশন দিবে স্কুল খোলার । কিন্তু সেই কাজ প্রায় দূঃসাধ্য হয়ে পড়ল । ২ মিনিট সময় কারো নেই ।আর সবার প্রশ্ন নতুন এসে আমি এসব করছি কেন ? আমি আশ্বস্ত করলাম ভয় নেই টিচার বোর্ড থেকে নিয়োগ দিবে । তাদের হাতে ফর্ম দিয়ে দেই ওনারা ফরম ফিলাপ করে দরজায় স্কচটেপ দিয়ে সেটে রাখে আমরা আবার কালেক্ট করে আনি । অবশেষে ক্লাশ শুরু হয় প্রতি শনিবারে । আমার জানামতে এখনো স্কুলটা চলছে ।
এখানে কিছু কথা উল্লেখ না করলেই না সেটা হলো কোন মানুষ যখন job less থাকে তাদের frustration কোন পর্যায়ে থাকে সেটা খুব কাছ থেকে দেখেছি আর নিজেও ভূক্তভোগী ছিলাম । ৯১ আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হবার পর থেকে ( ১৫, ১৬, ১৭) তিনটা বি, সি, এস পরীক্ষায় ভাইবা পর্যন্ত গিয়েছি অজ্ঞাত কারনে আমার চাকুরী হয় নাই । আবার যেকোন প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় রিটেনে পাশ করেছি , কিন্তু এক জায়গায় গিয়ে আটকে গেছি । দেশে এসব আমাকে খুব আহত করত তবুও বাচ্চাদের পালন, ওদের পড়াশুনা সব নিজে দেখেছি তাই অতটা বুঝতে পারেনি কেউ । এখানে যখন কিছু প্রফেশনাল মানুষকে এ রকম অবস্থায় দেখলাম সাহায্য করতে চেষ্টা করেছি , দুজনকে লাঞ্চরুম সুপারভাইজার হিসেবে কাজের জন্য প্রিন্সিপালকে অনুরোধ করেছি । প্রতিদিন ২ ঘণ্টায় ২০ ডলার , কম কি ! তাদের একজন এখন ম্যানিটোবায় ডাঃ আরেকজন আলবার্টা তে ভালো জবে আছেন । তারা হয়ত বলতেও লজ্জা পান সেই দিন গুলোর কথা ।
আমি কখনো একা থাকতে পারি না আমার বন্ধু ভাগ্য অনেক ভালো সে যে দেশীই হোক । আমার বিল্ডিং এর পাশে একটা সিনিয়র হাউজ ছিল, সেখান কার এক জনের সাথে স্কুলে যাওয়া আসার পথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল , নাম সুলতানা রাজিয়া তাঞ্জানিয়ার বাসিন্দা । সে পার্ট টাইম জব হিসেবে স্কুলের ক্রসিং গার্ড ছিল । একদিন খুব বিষন্ন মনে বলে তোমার যদি সময় থাকে যাবে আমার সাথে চার্চে ? আমি জিজ্ঞেস করলাম আমি আর তুমি দুজনেই মুসলিম চার্চে কেন যাব ? বলল আমি কখনো খৃষ্টানদের ফিউনারেল এ যায় নি । তুমি চলো আমার সাথে । আমার ইটালীয়ান রুম্মেট মেরী প্রিসিলো মারা গেছে ,ওকে শ্রদ্ধা জানাতে যাব, বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, রাজী হয়ে গেলাম আমি ।
মৃত্যুকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর প্রত্যেক ধর্মেই একটা রীতি আছে । তার পরিচিত প্রিয়জন সবাই কালো পোশাক পরে এসছে । ঢুকেই যে রুম সেখানে হাল্কা স্ন্যাক্স আর চা কফির ব্যবস্থ্যা , পাশে প্রজেক্টরে মেরীর ছোট বেলা থেকে যত ছবি আছে দেখাচ্ছে , তার পাশেই বড় রুম টায় সিরিয়াল অনুযায়ী লাইন ধরে সবাই কফিন এ ফুল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । পাশে দাঁড়ানো তার ছেলেমেয়েরা ।এরাও কাদছে কিন্তু নিজেদের সংবরণ করে । আমরা এগিয়ে গেলাম , এই প্রথম কোন বিস্ময়কর কোন কিছু দেখলাম । আমি থমকে দাড়ালাম , তাকে যে ভাবে সাজানো হয়েছে না জানলে বিশ্বাস হতো না , এই মানুষটি তিন দিন আগে মারা গিয়েছে। তার গায়ে হালকা গোলাপী সিল্কের গাউন, গলায় মূক্তার মালা , হাতে আংটি আর বুকের উপর সাদা, লাল আর গোলাপী গোলাপ ফুলের তোড়া । আর হাতে নেল পালিশ সহ খুব সুন্দর করে মেকাপ ক রা । এতো সুন্দর লাগছিল যে মনে হলো বিয়ের জন্য কনে সেজেছে ।এটাই নাকি ওদের রীতি তার প্রিয় জিনিষ দিয়ে শেষ বিদায় জানানো । আমরা বেড়িয়ে আসলাম , কিন্তু বুঝতে পারলাম ভালোবাসা আর কান্নার রং সব এক । তার সন্তানদের মায়ের প্রতি যে ভালোবাসা দেখলাম সত্যি শ্রদ্ধায় মন ভরে গেল । আমি আর রাজিয়া বাড়ির দিকে পথে নামলাম , অসীম আকাশে সেই মহা শক্তির কাছে প্রার্থনা করলাম , আমরা সবাই চলে যাব সেই অসীম শুন্যে , ভালো রেখো আমার এই অচেনা বন্ধুকে যার আত্মা চলে গেছে তোমার কাছে !
( চলবে )