প্লেনের চাকা টরন্টো পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে মৃদু ঝাকুনিতে অনেকেই নড়ে চড়ে বসলেও সদ্য অভিবাসী হয়ে আসা জামান সাহেবের ঘোর লাগা ভাব তখনো কাটেনি। সেই ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই অদ্ভুত এক নির্লিপ্ততা তাকে পেয়ে বসেছে। নুতন দেশে নুতন জীবনের অভিযাত্রায় পুলকিত হবার কথা। কিন্তু তিনি কিছুই অনুভব করছেন না। জামান সাহেব প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন পেজা তুলোর মতো গুড়ি গুড়ি তুষার পড়ছে। চারদিক ঢেকে আছে সাদা চাদরে। শুভ্র তুষারের উপর প্রতিফলিত হয়ে প্লেনের জানালায় এসেও পড়ছে সূর্য্যের আলো। জীবনে কোনোদিন তুষার না দেখা জামান সাহেব এই দৃশ্য দেখে স্বাভাবিক অবস্থায় লাফিয়ে উঠে উৎফুল্লতা প্রকাশ করার কথা। তিনি এর কিছুই করার আগ্রহ পাচ্ছেন না, বরং অনুভব করছেন অন্য রখম এক আড়ষ্টতা। বুঝতে পারছেন না ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সব ছেড়ে ছুড়ে টরোন্টোতে আসার সিদ্ধান্ত সঠিক হলো কিনা। তিনি নিজেও জানেন যে অভিবাসী হওয়ার পিছনের সব কারণের চুল চেরা বিশ্লেষণ করেই তিনি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারপরেও এতো দ্বিধা উড়ে এসে মনের ভিতর জুড়ে বসে কিভাবে ? জানেন না, কেন আঞ্চলিক প্রবাদ ‘স্থান ছাড়লে মান যায়’ বার বার তার মনে এসে ভিড় করছে। তিনি ভাবেন দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে যে জীবনের শুরু, সে জীবনে দৃঢ়তা আসার সম্ভাবনা কতটুকু? সিট্ বেল্ট অফ করার সংকেতে ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে জামান সাহেবের। ওভারহেড লকার থেকে ছোট একটি হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে প্লেন থেকে বের হবার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যান তিনি।
জামান সাহেবের জীবনের বাকি গল্প আর দশজন অভিবাসীর মতোই। “Life is Beautiful” ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের মতো জীবনের সব প্রতিকুলতাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে চাইলেও ’Tinted Vision’ নিয়ে প্রবাসে আসা জামান সাহেবকে বেগ পেতে হয় অনেক, পেরুতে হয় লক্ষ্যে পৌঁছানোর অনেক প্রতিবন্দকতা। অতি ভাগ্যবান কিছু মানুষের মতো তার সামনে আগানোর রাস্তা খুব মসৃন ছিল না। পেশাগত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কিছু ভালো মানুষের সংস্পর্শে এলেও স্ত্রীর অনুপ্রেরনা ও সহায়তা ছাড়া সত্যিকারের সহযোগিতা খুব একটা খুঁজে পাননি। এখনকার মত তথ্যের বহর এবং বাহার কোনটাই ছিল না তখন। কিন্তু দমে যাননি তিনি। স্রষ্টায় অগাধ বিশ্বাস ও অদম্য মনোবল নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন জামান সাহেব। মনে রেখেছেন মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম এইচ মাসলোর উক্তি, “লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে লেগে যাও কাজে। এমনভাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড় যেন এরই উপর নির্ভর করছে তোমার জীবন মরণ। ডুবে যাও কাজের মধ্যে, বুঁদ হয়ে যাও। দেখবে দেবতার আশীর্বাদের মতোই সুখের বৃষ্টি নামবে তোমার চারিপাশে।“ লক্ষ্য নির্ধারণেই অনেক সময় লেগে যায় তার। এরপর কেটে গেছে অনেকদিন। চারদিকে সুখের বৃষ্টি না নামলেও স্রষ্টার অপার করুনায় সিক্ত জামান সাহেবের এখন তৃপ্ত, প্রশান্তির জীবন কাটে। নিজের ইপ্সিত পেশাগত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পেরেছেন তিনি। খুঁজে পেয়েছেন নিজের কাজের সাথে সৃষ্টির সেবার ব্যতিক্রমধর্মী এক যোগসূত্র।
এই গল্প শুধু জামান সাহেবেরই নয়, এই গল্প আমাদের মতো হাজারো অভিবাসীর – যারা অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এক সময় একটি স্বস্তিকর পর্যায়ে পৌঁছে যান কিংবা যারা লক্ষ্য অর্জনের রাস্তায় এখনো হেটে চলেছেন অবিরাম। মনে রাখা রাখা দরকার জগত সংসার ও জীবনে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। স্থায়ী নয় বৈরি সময় ও। সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে জীবন ছুটে চলে তার নিজের গতিতেই। নদীর মতোই জীবনের গল্প, গল্পের জীবনও বয়ে চলে নিরবধি।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে
ছবি:-সৌজন্যে vov.vn