কাজের অনুসন্ধান:

আমি আমার অ্যাকাউন্টিং ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থায় প্রায় এক মাস চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া পাইনি এবং পরে সপ্তাহে কয়েক ঘন্টার জন্য   ম্যানহাটনের একটি রেস্টুরেন্টে অস্থায়ী কাজ  পেয়েছি।  কয়েক দিনের কাজের পর আমি এটি হারিয়ে ফেলি, এত দ্রুত কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।   

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম শীত:

১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে  এসেছি, প্রচন্ড ঠান্ডা বরফ , আমি প্রচণ্ড ঠান্ডা অনুভব করি। বাংলাদেশ এবং নাইজেরিয়ার আবহাওয়া গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং আমরা যখন বাইরে যাই অথবা   বাড়িতে থাকি হালকা পাতলা চাদর, বাসায়  কম্পোর্টার বা কাঁথা ব্যবহার করি; বাহিরে গেলে শীতকালীন সোয়েটারের প্রয়োজন হয়। প্রচন্ড ঠান্ডায় দেশে বাহিরে যেতে হলে ওলেন মোজা থেকে শুরু করে হেভি জ্যাকেট,বুট, গ্লাভস, টুপি সবই দরকার।   এদেশে বাহিরে যাওয়ার মতো আমার কোন শীতকালীন পোশাক ছিল না এবং আমার কাছে তিনশ পাউন্ড ছিল । আমি প্রায় সব কিছুই খরচ করেছি এবং শীতের পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। এই প্রথম শীতকাল, আমার কোনও শীতের পোশাক ছিল না এবং আমি আমার রুমমেটদের কাছ থেকে কিছু ডলার ধার নিয়েছি। প্রত্যেকেই একদিকে আমাকে নিরুৎসাহিত করতো এবং আবার কোনো না কোনো কাজ ও খোঁজ করতো।  রবিউল আমাকে বলেছিলো, বড়ো ভাই আপনার যেহেতু ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে এবং গাড়ি চালনার অভিজ্ঞতা ও আছে, আপনি আমার মতো ট্যাক্সি চালাতে শুইরু করেন । কিন্তু গাড়ি আকসিডেন্টের পর আমি আর গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে সাহস পাচ্ছি না, তাছাড়া সব সময় মাথা ব্যাথা থাকে , ডাক্তারের কাছে গেলে পেইন কিলার দিয়ে বলে এক্সিডেন্ট জনিত ব্যথা সহজে ভালো হবে না।    

অতিরিক্ত  ঠান্ডা এবং ভারী তুষারপাত এবং অসুস্থতার কারণে আমি হাঁটতে পারি  না।  আমার ডান পা ফুলে এমন হয়েছে যে   নড়াচড়া করতে পারি  না। ডাক্তার আমাকে কিছু ব্যাথার ট্যাবলেট ও মলম  দিয়েছিলেন, “আমি ভালো হওয়ার কোনো    লক্ষণ  দেখছি না, তার কারণ আমি দিনে হেঁটে হেঁটে কাজ খোঁজ করি।    ডাক্তার আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলছেন । কিন্তু, আমি একটি সোফায় ঘুমাচ্ছি; আমার ঘুমানোর জন্য কোন বিছানা নেই; আমি যাদের সঙ্গে আছি ওরা আমাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচে। প্রায় এক মাস, আমি নড়াচড়া করতে পারছি না এবং বাসায়  ছিলাম। 

নিউ জার্সি : 

ম্যানহাটনে একটি সংস্থা রয়েছে যারা ফি সংগ্রহের পরে বেকারদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করে।এরা লোকদের নিকট থেকে কোনো কাগজ পত্র চায় না । শুনে আমি কিছুটা উৎসাহিত হলাম  ম্যানহাটনে গিয়ে   এজেন্সিতে নির্ধারিত ফি প্রদান করে নিবন্ধিত হয়ে ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করি । প্রতিদিন সকালে ৮টা বাজে, আমি তার অফিসে যাই, সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়াই সিরিয়াল নম্বর নিয়ে এবং সময়ে সময়ে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করি যে তিনি আমার জন্য কোনও কাজ খুঁজে পেয়েছেন কিনা। তিনি বলেন, কেউ যদি আমাকে ডাকে, ‘আমি তোমাকে পাঠিয়ে দেব’। মনে এই ভরসা যে পয়সা যেহেতু দিয়েছি, কাজ পাবোই। ৪টা বাজে অফিস ছুটি, সবাইকে বলেন বাড়ি যাইতে এবং পরদিন সকালে আসতে; আমি অফিসের দরজা খুলার আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকি ।সবাই যুবক শিক্ষিত ছেলে বিভিন্ন উপায়ে এ দেশে এসে জড়ো হয়েছে এবং বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।  আমেরিকার সরকার, পুলিশ, ইমিগ্রেশন এ সব জেনেও  এদের এড়িয়ে চলে, কারণ অবৈধ  লোক দিয়ে  অল্প পয়সায় যে কাজ করানো যায়, বৈধ লোক দিয়ে তা সম্ভব না।  এ দেশের ব্যবসা বাণিজ্য চালাতে হলে এ সব অবৈধ লোকদের দরকার।  সে জন্য সরকার কিছুই বলে না।  

তিন বা চার দিন অপেক্ষার পর আমার সিরিয়েল আসলো , তিনি আমাকে নিউ জার্সির একটি রেস্টুরেন্টে পাঠিয়েছেন, কী ভাবে সেখানে যেতে হবে তা আমাকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন । এটি একটি গ্রীক রেস্টুরেন্ট এবং শ্রমিকরা বেশিরভাগই তরুণ মেক্সিকান। কাজটি আমার ভালো লাগেনি, কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। আমার কাজের সময় বিকেল ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। ইহুদি এলাকা, পাশেই লেক এবং বাড়িগুলি অতি চমৎকার। রাতের অন্ধকার এবং আলোতে অপরূপ সুন্দর দেখায় যেন গাছ এবং ফুলে ফুলে সাজিয়ে রেখেছে।   বাসা ৭ -৮  মিনিট হাঁটার পথ এবং প্রতিদিন বাসায় যাইতে পুলিশের গাড়ির সামনে পড়ি।  পুলিশ এলাকা পাহারা দিচ্ছে ; যদি ও আমি ভয় পাই ,আমাদের কাজের লোকদের ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।    

পা ফুলা এবং ব্যথা কমেনি; কিন্তু কিছুই করার নেই, বেঁচে থাকতে হলে কাজ করতে হবে ।  আমি খুব কমই হাঁটতে পারি, কোনও অভিযোগ নেই। আমার একটা কাজ আর ঘুমের জায়গা দরকার। আমি একজন বাংলাদেশী , অন্যরা সবাই ম্যাক্সিকান ২৪-২৫ বৎসরের যুবক ছেলে।  তারা কেবল তাদের নিজস্ব মেক্সিকান ভাষায় কথা বলে, হয় ইংরেজি বোঝে না বা আমাকে এড়িয়ে চলে। 

এক রাতে আমার কাজ শেষ হওয়ার পর, যখন আমি বাসায় গেলাম, আমি আমার বিছানাটি উল্টানো  দেখতে পেলাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে এটা করেছে! কেউ কিছু বলে না, পরের দিন আমি দেখলাম আমার কিছু   হারিয়ে গেছে। আমি ওদের বললাম ভাই তোমরা আমাকে একটু সাহায্য করো, ওরা নিজেরা কী কী বলে কিছুই বুঝি না।  রেস্টুরেন্টের মালিক কার কাছ থেকে শুনেছে যে ওরা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না ; ম্যানেজার এজেন্সিতে কথা বলে আমাকে বললেন যে তুমি যাও, এজেন্সী তোমার কাছ থেকে পয়সা নেবে না এবং অন্যত্র কাজের ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দেবে।   আমি যে কয়েকদিন কাজ করেছি পয়সা দিয়ে বিদায় দিলেন; আমি নেউয়র্ক চলে এসে এজেন্সিতে রিপোর্ট করলাম।   আমি ভয় পেলাম যে আমাকে ওই বাসায় আবার যেতে হবে এবং ছেলেপেলেদের সঙ্গে থাকতে হবে।  

আমি এজেন্সিকে রিপোর্ট করেছি এবং পরিস্থিতিটি ব্যাখ্যা করেছিসে বলে তুমি ফী একবার দিয়েছো, আর দিতে হবে না  , আমি তোমাকে  অন্য কোথাও পাঠাব। একই ভাবে আমি আসতে এবং যেতে শুরু করলাম। অ্যাপার্টমেন্টের ছেলেদের আমি ম্যাক্সিকানদের আচরণ বলেছি। তারা বলে যে আমরা ইতিমধ্যে আপনাকে বলেছিআপনি এই দেশে কাজ করতে পারবেন না, আপনি শোনেন না। আমি শুধু চুপ করে রইলাম এবং সিরিয়াসলি কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম ।

আমার নাইজেরিয়ায় থাকাকালীন পরিচিত  মিস্টার হোসাইন, ম্যাটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার  (কয়েক মাস হয় জান্নাতবাসী হয়েছেন) ব্রোকল্যান ,নেউয়র্ক থাকেন; অগত্যা তাঁর ওখানে  সিট নিয়ে চলে গেলাম।    তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের /সন্দ্বীপের মানুষের সঙ্গে বসবাস করছি। আপনার অবশ্যই ধৈর্য থাকতে হবে, জীবন এখানে সহজ নয়। আপনি যদি চান তবে এখানে আসতে  পারেন।আমি সরে পড়লাম;   প্রায় এক মাস, আমি নিয়মিতভাবে এজেন্সি এবং অন্যান্য উপায়ে চেষ্টা করেছি, পরে এজেন্সির ম্যানেজার আমাকে নিউজারসিতে এক   রেস্টুরেন্টের কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দিলেন যেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা সমস্ত  কিচেন   কর্মচারী । এজেন্সির ম্যানেজার বলছেন   এখানে তুমি স্থায়ীভাবে থাকতে পারবে। আমি আমার ব্যাগ নিয়ে বাসে করে চলে গেলাম।  রেস্টুরেন্টে ম্যানেজার আমাকে অন্য বাংলাদেশি রাঁধুনি ও সাহায্যকারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা ১১ জন লোক একটি বাড়ির  উপর ও বেসমেন্ট মিলে পাঁচ/ সাত মিনিট হাঁটার দূরত্বে বাস করি। সপ্তাহে ছয় দিন করে ডিউটি দিনে দশ ঘন্টা অর্থাৎ সপ্তাহে ৬০ ঘন্টা কাজ।   আমার মতো আরো কয়েকজনের কাজ সন্ধ্যা ৮টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত।  সন্ধ্যায়, আমি আলু, পেঁয়াজ পরিষ্কার করতে শুরু করি এবং মাঝে মাঝে রান্নাঘরের সাহায্য করি।

মধ্যরাতের পরে, যখন গ্রাহকরা আসছেন না, তখন পুরো রান্নাঘর এলাকা এবং ডাইনিং রুম, এবং কাস্টমার সার্ভিস এরিয়া ধোয়ামোছা শুরু হয়ে ভোর পর্যন্ত চলে। মধ্যরাতের পর   আমাদের ডিনারের সময়, কাস্টমার ভিড় থাকে না। 

বাহিরে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা বা শুভ্র তুলার মত বরফ পড়ছে; অথচ আমরা ভিতরে সাধারণ জামাকাপড় পরে ঘামে অস্থির এবং মাঝে মাঝে দরজা খুলে শরীরে ঠান্ডা লাগাই বা গার্বেজ নিয়ে বাহিরে বড়ো কনটেইনারে রাখি, মনেই হয় না যে বাহিরে কোনো ঠান্ডা আছে।

সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল আমার জন্য  বেসমেন্ট থেকে ১০০ পাউন্ড আলুর ব্যাগ কাঁদে করে কিচেনে নিয়ে আসা। আমার শরীরের  ওজন ১২৫ পাউনড , আমাকে বেসমেন্ট থেকে আলু ১০০ পাউন্ডের বস্তা আনতে  হতো  । 

আমি পিঠে ব্যথা অনুভব করতাম, ভয় পেতাম এই ভেবে যে  হয়তো এক সময়  আমি বিকলাঙ্গ হয়ে পড়বো। উপরে আনার জন্য কাউকে অনুরোধ করে কোনো সুফল হতো না, কারণ ম্যানেজমেন্ট এই কাজ আমাকে দিয়েছে আমি কাউকে  আলুর বস্তা উপরে আনার জন্য  অনুরোধ করে ও কাজ হতো না।  আমি অনেক সময় নীরবে চোখের পানি ও ফেলতাম এবং বুঝতাম ওরা কেন আমাকে বলেছিলো ” বড়ো ভাই আপনি এ দেশে  কাজ করতে পারবেন না;  আপনি দেশে চলে যান এবং দেশে ভালো কাজ করবেন।“  

একবার মাংস কাটার মেশিন পরিষ্কার করতে গিয়ে    আঙ্গুল কেটে ফেলেছি এবং রক্ত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিল, ম্যানেজার আমাকে হাসপাতালে নিলে ডাক্তার স্টিচ দিয়ে রেস্টুরেন্টে পাঠায়  । দৈনিক ১০ ঘন্টা এই কঠোর পরিশ্রমের কাজ করে  আমি খুব কমই হাঁটতে পারতাম এবং বিছানায় পড়ে  থাকতাম, বাকিরা অল্প বয়সী,সবাই শিপে কাজ করেছে , জিজ্ঞেস করলে বলে, আপনি বয়স্ক লোক,  দুর্বল শরীর এবং  কঠোর পরিশ্রম করার অভ্যাস নেই, সে জন্য এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, এ কাজে আমাদের এত কষ্ট হয় না। 

দুপুরে মেইল ম্যান   চিঠি নিয়ে আসে এবং বাংলাদেশে আমার স্ত্রী ও বাবা-মায়ের চিঠির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম । ডাকবাক্স বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে, আমাদের ছেলেপেলেরা চিঠি এনে বলে  “দাদা তোমার চিঠি আসছে ,”  শুনলে বেশ ভালো লাগতো ; বিছনা থেকে উঠে গিয়ে চিঠি নিয়ে আসি ।  কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলে দাদা কি খবর ? 

কিছুই বলার মতো নেই,চুপ করে থাকি।  

যে দিন অফ ডিউটি, হয় বিছানায় থাকি বা অন্যদের সাথে দেখা করতে বা কানাডা হাই কমিশন থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে নেউয়র্ক যাই। 

অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই এই রেস্টুরেন্টে  কাজ আমি আর বেশিদিন করতে পারবো না, হয়তো স্থায়ীভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে দেশে ফিরবো; কাজ ছেড়ে দিয়ে এজেন্সিতে চলে গেলাম এবং ম্যানেজারকে  অনুরোধ করলাম একটু হালকা কাজ দিতে । সে বলে তোমার কাগজ নেই, হালকা কাজ কোথায় পাবো ? 

কিছুক্ষন চুপ করে বলে অপেক্ষা করো দেখি কিছু পাই কিনা।    

ওকে আবার ফী দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম, আমার মতো লেবানিজ, ইন্ডিয়ান , পাকিস্তানী , যুগশ্লাভিয়ান এবং  আরও অনেক দেশের লোক এখানে রুম ভর্তি অপেক্ষা করছে। এদের সবাই আমার মতো বিভিন্ন ভাবে এ দেশে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে দেশে ডলার পাঠায়।  অনেকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এ দেশে এসেছে;কিন্তু  আমি নাইজেরিয়ান সরকারের পয়সায় এসেছি এবং ইচ্ছা করলে ওদের টিকেটে চলে যেতে ও পারি। 

 সারাদিনে সে হয়তো  তিন/চার জনকে কাজ দিতে পারে।  কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর আমার সিরিয়েল আসলো।   আমাকে নিউ জার্সির আটলান্টিকের পারে Sea beach   রেস্টুরেন্টে পাঠালো।  যাওয়ার আগে সে আমাকে বললো এখানে রেস্টুরেন্টে হালকা ধরণের খাওয়া তৈরী হয়, মূলত  sea beach এর লোকজন মজা (fun)  করার জন্য এসে হালকা ধরণের খাওয়া খেয়ে থাকে এবং তোমার কষ্ট কম হবে। তুমি কিচেন হেল্পার হিসাবে কাজ করবে, আমার মনে হয় আরামে থাকতে পারবে, তাছাড়া sea beach দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।। 

আটলান্টিকের পারে ছোট্ট রেস্টুরেন্ট; মালিক ও তার  স্ত্রী দুইজনই অস্ট্রিয়ান (   ইউরোপিয়ান) কিচেনে কাজ করে এবং ওয়েট্রেস সার্ভ করে, আমার কাজ ওদের দুইজনকে সাহায্য করা ডিশ  ওয়াশার প্লেট, চা কাপ কিচেন পট পরিষ্কার করে দেয়া। মাঝে মধ্যে কাস্টমার এরিয়া পরিস্কার করা।  মোটামোটি হালকা কাজ এবং সময় পাইলেই sea beach গিয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র জাহাজ আসাযাওয়া দেখি  এবং পানির ঢেউ দেখতে ভালোই লাগে।  লোকজনের sea beach আনন্দ দেখিবিরতির সময়   রেস্টুরেন্ট    থেকে ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে sea beach এবং সমুদ্র দেখি।   

আমার কাজের সময়সূচী  দুপুর ১টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত,ব্যবসা বন্ধ হলে উপরে গিয়ে  ঘুমানো আর জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা ও গর্জন শুনা; অনেক সময় এত জোরে বাতাস ও পানির আওয়াজ, মনে হতো এই বুঝি আমাদের রেস্টুরেন্ট উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, উঠে জানালার পর্দা খুলে দেখে আবার ঘুমাতে যেতাম । 

 আমরা দুইজন উপরে থাকি এবং নিচে কিচেনে গিয়ে যা যা দরকার খেয়ে আসি।  তবে ওদের খাওয়া পছন্দ হয় না, আমরা দুজনই বাংলাদেশী,নিজেরা রান্না করে খাই। আমার পার্টনারের কাজ  পুরো রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করা, লাইট বন্ধ করা এবং  দরজা বন্ধ করে রাত ১২:৩০ বাজে    রেস্টুরেন্টের উপরে এসে ঘুমানো।  

এক রাত তিনটার দিকে  নিচ তলা থেকে শব্দে   ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং সিকিউরিটি অ্যালার্ম বাজছিল। প্রথমে কী ঘটতে পারে তা শুনছি  এবং যে কোনও কিছুর জন্য প্রস্তুত হয়েছি। আমার সহকর্মী আমাকে পুলিশ কল করতে বললো । আমি বললাম, “আসুন আমরা প্রথমে তদন্ত করি কী  ঘটছে এবং পরে আমরা পুলিশ বা মালিককে কল করব।  আমরা দুই জন লোক, হাতের কাছে যা পেয়েছি তা হাতে নিয়েছি, ধীরে ধীরে নীচে রওয়ানা হচ্ছি। আমরা সিঁড়িতে পা পেলে এগুচ্ছি, আমরা লক্ষ্য করলাম নিচে আওয়াজ হচ্ছে , আমরা ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করতে শুরু করি এবং তৎক্ষণাৎ উপরে উঠে এসে আমাদের রুমের দরজা বন্ধ করে  পুলিশ এবং রেস্টুরেন্টের মালিক কে  জানাই। 

এই দুই ব্যক্তি শেষ গ্রাহক ছিলেন, ওয়েট্রেস বা ক্লিনার  খেয়াল করেনি যে তারা কোথায় লুকিয়ে আছে। সাধারণত, রেস্টুরেন্টের দরজা বন্ধ করার আগে, আমরা চেক করি এবং নিশ্চিত যে ওয়াশরুমে বা অন্য কোথাও কেউ নেই। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্যাশ বক্স চুরি করা। তারা জানত না যে আমরা উপরে আছি বা জেগে আছি । অন্যথায়; যতক্ষণ না তারা নিশ্চিত হয় যে আমরা ঘুমাচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ঝুঁকি নেবে না। তারা রেস্টুরেন্ট থেকে পালিয়ে যায় এবং কাছাকাছি লুকিয়ে থাকে। তৎক্ষণাৎ পুলিশ এসে এলাকাটি ঘিরে ফেলে এবং পুলিশের একটি গাড়ি রেস্টুরেন্টে এসে রেস্টুরেন্ট থেকে চুরি যাওয়া ব্যক্তিদের বর্ণনা সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞেস  করে। প্রাথমিকভাবে, আমরা নিশ্চিত না, তারা কিছু নিয়েছে কিনা তা আমরা জানতাম না, তাছাড়া আমি ভিতরে কিচেনে কাজ করি, কাস্টমার সম্পর্কে কিছুই জানি না। 

পুলিশ পুরো এলাকা খুঁজছিল, ঘটনার এক ঘন্টার মধ্যে তারা যে এলাকায় লুকিয়ে ছিল সেখান থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে, সনাক্ত করার জন্য রেস্তোঁরায় নিয়ে আসে। এই সময়ের মধ্যে রেস্টুরেন্টের মালিক এসেছিলেন এবং আমরা তাকে বলেছিলামরেস্টুরেন্টে কী ঘটেছিল এবং তিনি পুলিশের সাথে কথা বলেছিলেন এবং এই দুই সন্দেহভাজনকে সনাক্ত করেছিলেন। পরের দিন সকালে, পুলিশ ফোন করে আমাদের থানায় নিয়ে গিয়ে   তাদের সনাক্ত করে। আমরা দুইজনকে চিহ্নিত করেছিলাম, ওয়েট্রেস ও জানায়  ওরা  শেষ কাস্টমার ছিল। তদন্তের পরে, পুলিশ দেখেছে যে তারা কিছুই চুরি করেনি কারণ সুরক্ষার জন্য তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। মামলাটি কয়েক মাস ধরে চলছে এবং আমরা মালিকের কাছ থেকে মামলাটি সম্পর্কে শুনেছি যে তারা ছোটখাটো শাস্তি পেয়ে    কোর্ট থেকে মুক্তি পেয়েছে।  

কানাডায় ইমিগ্রেশন:

১৯৮৬ সন থেকেই আমি আমেরিকা থাকা এবং কয়েকটি দেশে চলে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি কানাডা এবং অন্যান্য কিছু দেশ  যেমন অস্ট্রেলিয়া ও নরওয়ে  ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করার পাশাপাশি কাজ করছিলাম। পাকিস্তান, বাংলাদেশ নাইজেরিয়াতে আমি অফিস  পরিবেশে, দীর্ঘ সময় (ফিনান্স একাউন্টিং )কাজ করতাম, আমার বিশ্বাস ছিল হয়তো কোথায় ও সুযোগ পেয়ে যেতে ও পারি। 

আমার নিউয়র্কের  সেই কথাগুলি বার বার মনে দোলা দিতো,” বড়ো ভাই দেশে আপনি কাজ করতে পারবেন না , আপনি দেশে চলে যান।“ 

 আমি রাতে  যেভাবে কাজ করছিলাম, দিনের আলো দেখতে পাইনি বলেই চলে ; কারণ আমি রাতে কাজ করেছি এবং দিনে ঘুমিয়েছি, এভাবেই আমি সময় পার করছিলাম এবং আমার স্ত্রী এবং বাবামায়ের চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম। 

আমার পার্টনার  রৌশন  পুরানো ঢাকার লোক , তাদের ঢাকা শহরে বাড়ি এবং ব্যাবসা  ; কিন্তু  আমেরিকার লোভ সামলাতে পারছে না।  তার কাছ থেকে অনেক ধরণের প্রাচুর্য্যের কাহিনী শুনতাম।   একবার তার স্ত্রীর কাছ থেকে  চিঠি পেয়েছে। মিসেস ক্যারল একজন ওয়েট্রেস ওর   পরিবার  সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিলেন যে তার স্ত্রী  ওকে  ছাড়া বাড়িতে কেমন আছে?

 সে বলছিলো   যে তার  স্ত্রী বাড়িতে সবকিছু নিজের হাতে করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। রান্না করার পাশাপাশি ঘর পরিষ্কার করতে সাহায্য করার মতো কেউ নেই।   

ক্যারল  আমেরিকার অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে চিন্তা করেছে এবং সবাইকে বলে, দেখো রৌশন কত বড়ো লোক, ওর স্ত্রী কাজের লোক না থাকাতে কমপ্লেইন করছে। সে একজন আমেরিকান, বাংলাদেশের অবস্থা জানার কথা না।   সে যুগে দেশে দুমুঠো ভাত পেলেই কাজের মেয়ে পাওয়া যেত।  আজকাল পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন রকম হয়েছে। সে আমার দেশের অবস্থা বুঝতে পারেনি বা তামাশা হতে পারে। রৌশন তাকে বলেছে,” আমি তোমাকে বাংলাদেশের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারি নি”  । বাংলাদেশে চাকর/চাকরানী পোষা  মোটেই ব্যয়বহুল নয়, খাবার , একটু শোয়ার জায়গা  এবং মাসে কয়েক টাকা দিতে পারলেই হলো।   এখানে এটি ব্যয়বহুল, ঘন্টায় ন্যূনতম মজুরির পাশাপাশি খাদ্য ও বাসস্থানও দিতে হবে।

 এক পর্যায়ে কানাডা হাই কমিশন, নেউয়র্ক আমার এপ্লিকেশন প্রসেস শুরু করে। হাই কমিশন আমাকে আমার এবং আমার স্ত্রীর পাশাপাশি সন্তানদের জন্য আবেদনের নির্ধারিত ফি পাঠাতে বলেছে। আমার স্ত্রী সন্তানরা বাংলাদেশের ঢাকায় থাকে এবং আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে থাকি। 

হাই কমিশন আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করে এবং আমাকে গত দশ বছর থাকা বিভিন্ন জায়গা থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের  কাগজপত্র পাঠাতে বলে। 

আমি বিপদের সম্মুখীন হলাম, নাইজেরিয়া থেকে আমি ডিপার্মেন্টাল সার্টিফিকেট এনেছি; পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ওই দেশে যাওয়া কোনোদিন ও সম্ভব হবে না।   বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে ছিলাম যেমন  পাবনা, কুমিল্লা, কচুয়া(নিজের বাসস্থান)  এবং ঢাকার পুলিশ ভেরিফিকেশন চিন্তা করা যায় না।   আমি ধরে নিয়েছি যে এ অযথাই কষ্ট করা হলো, আমার ইমিগ্রেশন হবে না।  আমেরিকার  পুলিশ ভেরিফিকেশন পেতে  ১০ ডলার ফী দিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিলে ১ মিনিটের মধ্যে  (ক্রিমিনাল ) নাই বলে রিপোর্ট বেরিয়ে আসে। যদিও আমি একটি আশা পেয়েছিলাম, কিন্তু কাগজপত্র সংগ্রহ করা খুব কঠিন , কারণ আমি ইতিমধ্যে নাইজেরিয়া এবং বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছি যেখানে আমি গত দশ বছর ছিলাম। 

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কয়েকমাস চলে গেলো, বাংলাদেশ থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশন সংগ্রহ করতে পারছি না।  নিরুপায় হয়ে আমি আমার হেডমাস্টার শ্রদ্ধেয় হাসান আলী সাহেবকে( আজ আর জীবিত নেই) অনুরোধ করে বলেছিলাম স্যার আমার এ উপকারটুকু দরকার।  স্যার অনেক অসুস্থ্য আমাকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন আমি একটু সুস্থ্য হলে চেষ্টা করে পাঠিয়ে দেব। কিছুদিন পর উনি আমাকে চান্দিনা , কুমিল্লার পুলিশ ভেরিফিকেশন পাঠিয়ে দিলেন এবং বললেন”Best  of  luck “।  আমি আমেরিকা ও বাংলাদেশের একটা (কুমিল্লা) ভেরিফিকেশন নিজে গিয়ে দেখা করে ফাইলে দিলাম।  অফিসার বলে তোমার বাকি রিপোর্ট ও দিতে হবে। 

আমি অপেক্ষা না করে শেষে নিরুপায় হয়ে  শ্রদ্ধেয় মিস্টার কাদের,( জয়েন্ট সেক্রেটারি, বাংলাদেশ সরকার)  কে টেলিফোন করে অনুরোধ করি, ” আমার এ উপকার টুকু না করলে আমার ইমিগ্রেশন হচ্ছে না। মিস্টার কাদের আজ আর জীবিত নেই, (তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি),  অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চান্দিনা,  কুমিল্লা, কচুয়া এবংঢাকার দশ বৎসরের পুলিশ ভেরিফিকেশন সংগ্রহ করে এবং নিজে সার্টিফিকেট দিয়ে  আমাকে রেজিস্ট্রি করে পাঠিয়ে দিয়ে বলেন, আমি তোমার এবং তোমার পরিবারের অবস্থা অনুধাবন করে এই কাজটুকু করলাম।  দোআ করি তুমি ইমিগ্রেশন পেয়ে কানাডা সুখে থেকো । 

১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে আমি ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র পেয়েছি এবং আমার পরিবারও কানাডিয়ান হাই কমিশন, ঢাকা থেকে পেয়েছিল। ১৯৮৮ সালের অগাস্ট/ সেপ্টেম্বর থেকে কানাডার মতো একটি দেশে বাস করছি। আল্লাহর অসীম মেহেরবানী আমি স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে এত সুন্দর একটি দেশে আছি।  

সমাপ্ত  

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিনামূল্যে চারা বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধ১লা বৈশাখ ও পান্তাভাত
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন