বিশ বছর চাকুরী জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে পি আর ও হিসাবে কাজ করেছি। পি আর ও- অর্থাৎ পাবলিক রিলেশন অফিসার / জনসংযোগ কর্মকর্তা / তথ্য অফিসার। প্রত্যেক মন্ত্রনালয়ে একজন পি আর ও থাকেন মন্ত্রনালয়ের জনসংযোগ কাজকর্ম দেখাশুনা করার জন্য। তথ্য মন্ত্রনালয়ের পরামর্শ মতে তথ্য অধিদফতর বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে পি আর ও নিয়োগ দিয়ে থাকেন। জনসংযোগ কর্মকর্তা / পি আর ও হিসাবে প্রথম কাজ শুরু করছিলাম কৃষি মন্ত্রনালয়ে। এই কৃষি মন্ত্রনালয়ে বদলি ও কাজে যোগদানের প্রেক্ষাপট নিয়ে আজকের লেখায় কিছু আলোকপাত করবো।
তখন ১৯৯১ সালের মে মাস। আমি কিছুদিন আগে খুলনা আঞ্চলিক তথ্য অফিস থেকে ঢাকা পি আই ডি (তথ্য অধিদফতর) সদর দফতরে বদলি হয়ে এসেছি। সংবাদ কক্ষে নিউজ লেখা প্রাকটিস করছি। একদিন আমার ব্যাচমেট ও সহকর্মী বন্ধু ড: মোহাম্মদ হান্নান এসে বললো “তুই কি কৃষি মন্ত্রনালয়ের পি আর ও হতে ইচছুক?” আমি তখন কিংকর্তব্যবিমুড় ! মন্ত্রনালয়ে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া একটি বড় মন্ত্রনালয়ে একজন সিনিয়র মন্ত্রীর পি আর ও হিসাবে আমাকে কেন পোস্টিং দেবেন প্রধান তথ্য অফিসার / পি আই ও (পি আই ডির হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট) সাহেব ? ড: হাননান বললেন সেটা আমি দেখব। তবে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে তোর আগে একটা ইন্টারভিউ দিতে হবে।
একদিন ড: হান্নান আমাকে মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে নিয়ে গেল। মন্ত্রী মহোদয় একজন সাবেক মিলিটারী জেনারেল। তিনি আমাকে বেশ কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন এবং কিছু প্রশ্ন করলেন। আগে মন্ত্রীর পি আর ও হিসাবে কাজ করেছি কিনা জিজ্গসা করলে আমি বললাম করি নাই। আশা নিরাশার দোদুল্যমান অবস্থায় পি আই ডি তে ফিরে আসলাম। কয়েকদিন পরে দেখি আমাকে বদলি করা হয়েছে কৃষি মন্ত্রনালয়ের পি আর ও হিসেবে। পরে জেনেছি আমার আগেও আমার কয়েকজন কলিগের ইন্টারভিউ নিয়েছেন মন্ত্রী মহোদয়,তবে তাদের কাউকে তিনি পছন্দ করেননি।
যাইহোক, মন্ত্রী মহোদয়ের অভিপ্রায় অনুযায়ী আমি অনতিবিলম্বে কৃষি মন্ত্রনালয়ে কাজে যোগদান করলাম। তবে একটা বিষয়ে আমার খটকা মোটেই দূর হচ্ছিল না। সেটা হল ড: হান্নান লেখাপড়া জানা অফিসার এবং পি আর ও হিসেবে বেশ ভালো। তা সত্তেও কেন মন্ত্রী তাকে রাখতে চাইলো না। এ বিষয়ে ড: হান্নান কে জিজ্গাসা করলে সে যে বিষয়ে আমাকে তাত্ক্ষণিক কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল “মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আমার এডজাস্ট হয়নি। তবে তুই পারবি বলে আমি বিশ্বাস করি।”
অতিসম্প্রতি, আমি কিছু জরুর্রী কাজের জন্য বাংলাদেশে গিয়াছিলাম গতমাসে এবং মাত্র তিন সপ্তাহ পরে কাজ শেষে আবার টরন্টো ফিরে আসি। ফেরার পথে ঢাকায় ২/৩ দিন ছিলাম। এ সময় আমার সাবেক কর্মস্থল গণযোগাযোগ অধিদফতরে গিয়াছিলাম কিছু সময়ের জন্য। পুরানো বন্ধু ও কলিগদের সাথে আলাপের সময় দফতরের একজন পরিচালক আমার স্নেহভাজন ফয়জুল হক আমাকে বি সি এস ইনফরমেশন এসোসিয়েশণের কয়েকটা স্মরনিকা দিয়েছিল অবসর সময়ে পড়ার জন্য। এ স্মরনিকা গুলির মধ্যে ২০১০ সালের স্মরণিকায় ড: হান্নানের পি আর ও জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি লেখা পড়ছিলাম। তখন তার এ লেখাটি থেকে আমি দীর্ঘ প্রায় বিশ বছর পরে অতিদ্রুত ড: হাননানের বদলি ও আমার কৃষি মন্ত্রনালয়ে তড়িঘড়ি করে বদলির প্রেক্ষাপট আরো পরিষ্কার ভাবে জানতে পারলাম।
ড: হান্নান তার স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে যেভাবে লিখেছেন সেটা আমি কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে উল্লেখ করছি-
“তখন ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়। একদিন এক পীরসাহেবের চ্যালা এসে বললেন, আমাদের পীরসাহেবের স্বপ্নে পাওয়া এক জ্যোতি পাউডারের উপর একটা ক্রোড়পত্র প্রকাশ হবে। এতে মন্ত্রী মহোদয়ের বাণী দিতে হবে। অন্য মন্ত্রীরাও এতে বাণী দিয়াছেন। হান্নান বললেন এটা তো একটা বিজ্ঞাপন। এতে মন্ত্রী বাণী দেবেন কেন। আমি এ ধরনের বিষয়ে মন্ত্রীর বাণী দিয়ে তার ইমেজ নষ্ট করতে পারি না।
পীরসাহেবের চ্যালা এতে ভীষণ নাখোশ হলেন এবং বললেন অনেক মন্ত্রীই এতে বাণী দিয়েছেন । আপনি না দিয়ে ভালো করলেন না। সে রাগ করে আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন এবং একসময় অন্য লোকজনের সাথে মন্ত্রী মহোদয়ের রুমে ঢুকেও গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে আমার ডাক পড়ল মন্ত্রীর রুমে। মন্ত্রী মহোদয় বললেন উনার বাণীটা রেডি করে দিন।আমি বললাম ওটা বাণী নয় বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে স্যার। একটা পাউডারের জন্য কেন আপনি বাণী দেবেন?
মন্ত্রী বললেন, আহ তর্ক করবেন না তো ! বাণীটা তৈরী করে দিন। অনেক মন্ত্রিই তো দিয়াছেন।আমি না দিলে পীর সাহেব রাগ করবেন।
আমি বললাম স্যার এটা ঠিক হবি না,তবে আপনি বলছেন তাই আমি তৈরি করে দিব।আমার কথায় মন্ত্রী মহোদয় খুশি হলেন বলে মনে হলনা । নিজের রুমে এসে বাণী তৈরি করতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমার রুমের ‘নীল টেলিফোন ‘ বেজে উঠলো। ফোনের অপর প্রান্তে পি আই ডির কর্ণধার প্রধান তথ্য অফিসার মহোদয়। তিনি বললেন, তা বাপু তোমাকে তো ওখানে পলিটিকস করতে পাঠানো হয়নি! আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ! তাকে জিজ্গসা করলাম, আমি পলিটিকস করলাম কখন স্যার ? তিনি বললেন এই মাত্র মন্ত্রী মহোদয় তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন, তুমি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক!
আমি বললাম স্যার এত কোনো পলিটিকস নয়, মন্ত্রী মহোদয়ের ইমেজ খারাপ হবে মনে করে আমি পীর সাহেবের………..আমার কথা স্যার শেষ করতে দিলেন না। তিনি বললেন দেখো বাপু আমি সব বুঝি, বাণীটা দিলে কি হত ! আমি আবার বললাম স্যার এ বাণী দিলে মন্ত্রী মহোদয় একটা বিজ্ঞাপনে অংশ নিতেন।
প্রধান তথ্য অফিসার মহোদয় বললেন আমার মনে হয় তোমার ঐ মন্ত্রনালয়ে আর থাকা ঠিক হবেনা। মন্ত্রী মহোদয় তোমাকে বদলি করার জন্য আমাকে বলেছেন। আমি বললাম ঠিক আছে স্যার বাংলাদেশ টেলিভশন থেকে আমার নামে মন্ত্রনালয়ে যে রিকুইজিশনটা এসেছে আমাকে সেখানে বদলির জন্য তথ্য মন্ত্রনালয়ে আপনি একটু বলে দিন। তিনি বললেন ঠিক আছে, ঠিক আছে। দুদিনের মধ্যে আমার টেলিভশনে বদলির আদেশ পেলাম। বাণীটা আর লেখা হলনা। ওই দিনই আমি বি টি ভি তে কাজে যোগদান করলাম।
কয়েকদিন পরে সেই জ্যোতি পাউডারের ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হলো। প্রকাশের পরদিন দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাউডারের বিজ্ঞাপনে মন্ত্রীদের বাণী প্রদানের বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করা হলো। সব মন্ত্রীরা তাদের পি আর ও দের তিরস্কার শুরু করলেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও মন্ত্রীদের তাদের কান্ডজ্ঞানের সমালোচনা করলেন।
এর কয়েকদিন পরে সন্ধায় মন্ত্রী মহোদয় বাসায় ফোন করে বললেন কি হল হান্নান ,অফিসে আসছেন না যে ! আমি বললাম স্যার আমাকে তো আপনি বদলি করে দিতে বলছিলেন , তাই মন্ত্রনালয় আমাকে বি টি ভি তে বদলি করে দিয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় বললেন বদলি অল রেডী করে দিয়েছে ? আমি বললাম জী স্যার। মন্ত্রী বললেন সেটা তো আমি এমনিই বলছিলাম। বললাম আমি সেখানে ইতিমধ্যে যোগদানও করেছি। দোয়া করবেন স্যার। ”
মন্ত্রী মহোদয় একটু পরে আবার ফোন করে বললেন হান্নান, আমার একটা উপকার করবেন ? আমি বললাম অব্যশই করব স্যার ,বলুন আমাকে কি করতে হবে ।মন্ত্রী মহোদয় বললেন আপনি কি আমাকে পি আই ডি তে কর্মরত আপনার মত একজন অফিসারের সন্ধান দিয়ে যেতে পারেন?-” ড: হাননানের লেখা থেকে উদ্ধৃতি এখানেই শেষ করলাম।
আসলে আমার লেখাও প্রায় শেষ পর্যায়ে!! আশা করি আমার পি আর ও হিসাবে প্রথম বদলির প্রেক্ষাপট যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পেরেছি। ভবিষতে আমার কর্মজীবনের অন্যান্য ঘটনা জানানোর প্রতিশরুতি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি।
চমৎকার, পরের লেখাটা তাড়াতাড়ি দিবেন দয়া করে 🙂
ধন্যবাদ,আমি চেষ্টা করব।
আমলাদের উপর হামলা….!!!